আমার মনে হয়, তুমি নিশ্চয়ই কখনো না কখনো নিজের জীবনে বড় সংকটে পড়েছো। সেই মুহূর্তে মনে হয়েছে, সব দিক যেন অন্ধকার। কিন্তু ভেবে দেখো, মহাভারতের অর্জুনও এমনই এক ভয়ানক সংকটে পড়েছিল, যেখানে তাকে যুদ্ধ করতে হবে নিজের আপনজনদের বিরুদ্ধে। কিন্তু কীভাবে সে এই আধ্যাত্মিক সংকট কাটিয়ে উঠেছিল? আজ আমরা সেটাই আলোচনা করব।
অর্জুনের সংকট: এক নজরে
কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের ময়দানে অর্জুন যখন তাঁর গাড়ির ওপরে দাঁড়িয়ে ছিলেন, তখন তিনি একটি গভীর দ্বন্দ্বে পড়েন। তাঁর নিজের পরিবারের মানুষদের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে যুদ্ধ করতে হবে, এই চিন্তা তাঁর মনকে আচ্ছন্ন করে। তিনি বলেন, “যদি আমি আমার আত্মীয়দের হত্যা করি, তবে এই জগতে কীসের সুখ পাবো?” (“ভগবদ গীতা”, ১.৩৬)। অর্জুন তখন ধনুক ফেলে দেন এবং যুদ্ধ না করার সিদ্ধান্ত নেন।
কৃষ্ণের ভূমিকা: সত্যের পথপ্রদর্শক
তোমাকে বলতে হবে, জীবনের সংকটে যখন তুমি দিশেহারা হয়ে পড়ো, তখন তোমার একজন সত্যিকার পথপ্রদর্শকের প্রয়োজন হয়। অর্জুনের জন্য সেই পথপ্রদর্শক ছিলেন কৃষ্ণ। কৃষ্ণ তাঁকে বলেন, “ক্লৈব্যং মা স্ম গমঃ পার্থ।” (“ভগবদ গীতা”, ২.৩) অর্থাৎ, “হে পার্থ, দুর্বলতা তোমাকে আচ্ছন্ন না করুক।”
তুমি দেখবে, কৃষ্ণ অর্জুনকে শুধু যুদ্ধ করার জন্যই অনুপ্রাণিত করেননি, তিনি তাঁকে জীবনের গভীর সত্যও বুঝিয়েছেন।
ধর্ম ও কর্তব্যের শিক্ষা
তুমি জানো কি, অর্জুনের সংকট শুধু ব্যক্তিগত ছিল না, তা ছিল একটি আধ্যাত্মিক দ্বন্দ্ব। কৃষ্ণ তাঁকে মনে করিয়ে দেন, “স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়ঃ পরধর্মো ভয়াবহঃ।” (“ভগবদ গীতা”, ৩.৩৫) অর্থাৎ, নিজের ধর্ম অনুযায়ী কাজ করাই সর্বোত্তম, অন্যের ধর্ম অনুসরণে সর্বদা ভয় থাকে।
অর্জুন বুঝতে পারেন, তাঁর কর্তব্য কেবল যুদ্ধ করা নয়, তাঁর ধর্ম রক্ষা করা। তুমি যদি নিজের জীবনে এই নীতি প্রয়োগ করো, তবে অনেক সমস্যার সমাধান পেয়ে যাবে।
অর্জুনের শিক্ষা: ৩টি উদাহরণ
- স্বীয় কর্তব্যে অটল থাকা: অর্জুন প্রথমে ভেবেছিলেন, যুদ্ধ মানেই হিংসা। কিন্তু কৃষ্ণ তাঁকে বোঝান, হিংসা তখনই ঘটে যখন তা স্বার্থপরতায় পরিচালিত হয়। তোমার যদি কখনো এমন মনে হয় যে, কঠোর সিদ্ধান্ত নেওয়া ভুল, তবে ভাবো, সেই সিদ্ধান্ত কি বৃহত্তর কল্যাণের জন্য? অর্জুন শেষ পর্যন্ত তাঁর কর্তব্য পালন করেছিলেন।
- আত্মসমর্পণ: অর্জুন যখন কৃষ্ণের শরণাপন্ন হলেন এবং বললেন, “শিষ্যস্তে ” (“ভগবদ গীতা”, ২.৭), তখন তিনি সত্যিকার অর্থেই নিজের অহংকার ত্যাগ করেন। তুমি যদি কখনো বুঝতে পারো যে, নিজের সীমাবদ্ধতা আছে, তবে আত্মসমর্পণ করতে দ্বিধা করো না। এই আত্মসমর্পণ তোমার জীবনের দিশা বদলে দিতে পারে।
- অপরিহার্য সত্য মেনে নেওয়া: কৃষ্ণ অর্জুনকে বলেন, “ন যান্তি তে পরাং গতিম।” (“ভগবদ গীতা”, ২.৫১) অর্থাৎ, যারা ফলের প্রতি আসক্ত হয় না, তারা জীবনের চরম লক্ষ্য অর্জন করে। এই দৃষ্টিভঙ্গি অর্জুনকে তাঁর সংকট কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করেছিল।
সংকট কাটানোর জন্য তোমার পথ
তুমি যদি অর্জুনের মতো নিজের সংকটে পড়ো, তাহলে কিছু পদ্ধতি অনুসরণ করতে পারো:
- নিজের মনের কথা শোনো: প্রথমেই বুঝে নাও, তুমি ঠিক কী সমস্যায় আছো। অর্জুন তাঁর মনের কথা শুনেছিলেন।
- সঠিক পরামর্শ গ্রহণ করো: অর্জুন কৃষ্ণের কাছে পরামর্শ নিয়েছিলেন। তোমারও উচিত অভিজ্ঞ কাউকে পাশে রাখা।
- ধর্মের পথে চলো: নিজের জীবনের লক্ষ্য ঠিক করো এবং সেই অনুযায়ী কাজ করো।
মহাভারতের শিক্ষা: জীবনের জন্য পথনির্দেশ
অর্জুনের সংকট ও তার সমাধান আমাদের শেখায়, জীবনের কঠিন পরিস্থিতিতেও স্থির থেকে নিজের কর্তব্য পালন করতে হয়। কৃষ্ণ বলেন, “যোগঃ কর্মসু কৌশলম্।” (“ভগবদ গীতা”, ২.৫০) অর্থাৎ, দক্ষতার সাথে কাজ করাই যোগ।
তোমার জীবনেও যদি এমন পরিস্থিতি আসে, তবে মনে রেখো, সংকটই তোমাকে শক্তিশালী করে। তোমার মনের ভয় ত্যাগ করো এবং জীবনের চরম সত্যকে মেনে নাও।
শেষ কথা
তোমার জীবনে যদি কখনো মনে হয়, সব কিছু হারিয়ে গেছে, তবে একবার ভেবে দেখো, অর্জুনও তো এমনই অনুভব করেছিলেন। তাঁর শিক্ষা কি তোমাকে সাহায্য করতে পারে না? কুরুক্ষেত্রের ময়দান থেকে অর্জুন আমাদের শিখিয়েছেন, সংকটের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে জীবনের সবচেয়ে বড় পাঠ। তুমি কি আজ থেকে সেই পাঠ গ্রহণ করবে?