আপনার জীবনের কোনো কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে কি কখনও মনে হয়েছে, “আমি ঠিক করছি তো?” এই প্রশ্নটাই অর্জুনের মনে উঠেছিল মহাভারতের কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের প্রাক্কালে। অর্জুন, যিনি ছিলেন একজন দক্ষ যোদ্ধা এবং কৌরব ও পাণ্ডবদের মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধের প্রধান নায়ক, যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে মানসিক দ্বন্দ্বে পড়েছিলেন। কেন? কারণ, তার সামনে দাঁড়ানো শত্রুরা কেউ অপরিচিত ছিল না; তারা ছিল তারই আত্মীয়-স্বজন, গুরু এবং বন্ধুবান্ধব। এই দ্বিধা ও সংশয় আমাদের জীবনের প্রতিফলন হতে পারে, যেখানে ন্যায় ও সম্পর্কের মধ্যে ভারসাম্য খুঁজে বের করা কঠিন হয়ে পড়ে।
অর্জুনের মানসিক দ্বিধার পটভূমি
যুদ্ধ শুরুর ঠিক আগে অর্জুন যখন কুরুক্ষেত্রের ময়দানে দাঁড়িয়ে আছেন, তার মন এক অদ্ভুত সংশয়ে ভরে যায়। তিনি ভাবতে থাকেন, “এই যুদ্ধের ফলে আমার প্রিয়জনদের মৃত্যু হবে। এমনকি যদি আমি জয়ী হই, সেই জয়ের কোনো অর্থ থাকবে কি, যদি আমার পরিবার আর গুরুরা না থাকেন?” এই দ্বন্দ্বের কারণেই তিনি শ্রীকৃষ্ণকে বলেন:
“যেষ্ঠ্রেয়স্যা নিশ্চিতং ব্রূহি তন্মে শিষ্যস্তে” (শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা) – অর্থাৎ, “আমি আপনার শিষ্য; আমাকে বলুন, কোন পথ আমার জন্য সঠিক।”
অর্জুন এখানে একজন সাধারণ মানুষের মতোই আচরণ করছেন, যিনি জীবনের জটিল পরিস্থিতিতে সঠিক দিকনির্দেশনার জন্য কাউকে পাশে চান।
অর্জুনের দ্বিধার কারণ
১. নৈতিক দ্বন্দ্ব: অর্জুন ভাবছিলেন,
“আপনার পরিবারের বিরুদ্ধে তলোয়ার তোলা কি সঠিক? আমার প্রিয়জনদের হত্যা করার অধিকার কি আমার আছে?” এই প্রশ্ন তার নৈতিক মূল্যবোধের সঙ্গে সংঘর্ষ তৈরি করে।
২. কর্মফলের চিন্তা: অর্জুন মনে করেছিলেন, যুদ্ধের ফলে তিনি যা অর্জন করবেন তা সবই শূন্য হয়ে যাবে। তিনি বলেন:
“ন কাংক্ষে বিজয়ং কৃষ্ণ ন চ রাজ্যং সুখানিচ।” (শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ১.৩২) – অর্থাৎ, “আমি বিজয় চাই না, রাজ্য চাই না, এমনকি সুখও চাই না।”
৩. সম্পর্কের প্রতি টান: অর্জুনের শত্রুদের মধ্যে ছিলেন তার গুরু দ্রোণাচার্য, মাতামহ ভীষ্ম, এবং অন্য অনেক আত্মীয়স্বজন। তিনি ভাবতে পারেননি যে তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করবেন।
শ্রীকৃষ্ণের পরামর্শ
অর্জুনের দ্বিধার উত্তরণের জন্য শ্রীকৃষ্ণ যে পরামর্শ দিয়েছিলেন, তা আজও আমাদের জীবনে প্রাসঙ্গিক। তিনি বলেন:
১. কর্মযোগের শিক্ষা: শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলেন:
“কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন।” (শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা) – অর্থাৎ, “তোমার অধিকার কেবল কাজ করার উপর; ফলের উপর নয়।”
এই শিক্ষা আমাদের শেখায় যে আমরা আমাদের দায়িত্ব পালন করি, কিন্তু ফলাফলের উপর অতিরিক্ত মনোযোগ না দিই।
২. আত্মা অবিনশ্বর: শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে মনে করিয়ে দেন যে আত্মা অমর। তিনি বলেন:
“ন জায়তে ম্রিয়তে বা কদাচিন্…” (শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা) – অর্থাৎ, “আত্মা কখনও জন্ম নেয় না এবং কখনও মরে না।”
এই জ্ঞান অর্জুনকে মৃত্যুর ভয় কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করেছিল।
৩. ধর্মের পালন: শ্রীকৃষ্ণ বলেন,
“স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়ঃ পরধর্মো ভয়াবহঃ।” (শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা) – অর্থাৎ, “নিজের ধর্ম পালন করা সর্বোত্তম, এমনকি যদি তা তোমার মৃত্যু ডেকে আনে।”
অর্জুনের ক্ষেত্রে, তার ধর্ম ছিল একজন ক্ষত্রিয় হিসেবে যুদ্ধ করা এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো।
উদাহরণ দিয়ে উপলব্ধি
আমাদের জীবনের বিভিন্ন পরিস্থিতিতে অর্জুনের দ্বিধার সঙ্গে মিল পাওয়া যায়। উদাহরণস্বরূপ:
১. কর্মজীবন বনাম পরিবার: অনেক সময় আমরা কাজের জন্য পরিবার থেকে দূরে যেতে বাধ্য হই। তখন আমরা ভাবি, “আমি কি নিজের স্বার্থের জন্য প্রিয়জনদের কষ্ট দিচ্ছি?”
২. ন্যায় বনাম সম্পর্ক: আপনার বন্ধুরা যদি ভুল কিছু করে এবং আপনি তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়ান, তখনও আপনি মানসিক দ্বিধায় পড়েন।
৩. সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া: অনেক বড় সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময়, যেমন চাকরি পরিবর্তন বা ব্যবসা শুরু করা, আমরা অর্জুনের মতোই সংশয়ে পড়ি।
মহাভারতের শিক্ষা আপনার জীবনে
আমাদের জীবনে মহাভারতের শিক্ষাগুলি কেবল গল্পের অংশ নয়, এটি জীবনের একটি মন্ত্র। অর্জুনের মতোই, আমাদের জীবনেও দ্বিধার মুহূর্ত আসবে। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণের কথাগুলি আমাদের দিকনির্দেশনা দিতে পারে।
আপনার জীবনের এমন কোনো পরিস্থিতি কি ছিল যেখানে আপনি অর্জুনের মতো দ্বিধায় পড়েছিলেন? কীভাবে আপনি সেই পরিস্থিতি সামলেছেন?
আমাদের জীবনের এই প্রশ্নগুলিই আমাদের ভাবনার গভীরে নিয়ে যায়। মহাভারতের শিক্ষা গ্রহণ করে, আমরা কি আমাদের জীবনের বড়ো প্রশ্নগুলির উত্তর খুঁজে বের করতে পারি না?
উপসংহার
অর্জুনের দ্বিধা আমাদের শেখায় যে জীবনের বড়ো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সংশয় আসা স্বাভাবিক। তবে শ্রীকৃষ্ণের পরামর্শ গ্রহণ করে আমরা সঠিক পথে এগিয়ে যেতে পারি।
মহাভারতের প্রতিটি শ্লোকই একটি জীবনবোধের আলো, যা আমাদের জীবনের অন্ধকার দূর করতে পারে। তাই, আপনার জীবনে যখনই কোনো দ্বিধার মুহূর্ত আসে, আপনি কি অর্জুনের মতো শ্রীকৃষ্ণের কাছ থেকে অনুপ্রেরণা নেবেন?