অর্জুন গীতার শিক্ষায় কীভাবে সুখ খুঁজে পেয়েছিলেন?

আমাদের জীবনে সুখ খুঁজে পাওয়া একটি গভীর আকাঙ্ক্ষা। তবে সেই সুখ কি বাহ্যিক জগৎ থেকে আসে, নাকি আমাদের অন্তরের শান্তি থেকেই? মহাভারতের অর্জুনের জীবন এ প্রশ্নের এক অসাধারণ উত্তর প্রদান করে। শ্রীমদ্ভগবদগীতার শিক্ষার মাধ্যমে অর্জুন শুধু যুদ্ধক্ষেত্রে নিজের পথ খুঁজে পাননি, তিনি জীবনের গভীর অর্থও উপলব্ধি করেছিলেন।

অর্জুনের দোলাচল ও সুখের সন্ধান

যখন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে অর্জুন তার আত্মীয়স্বজন ও প্রিয়জনদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করতে সংকোচ বোধ করলেন, তখন তার মন সংকটগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল। তিনি ভাবছিলেন, “এত রক্তপাতের মাঝে কীভাবে সুখ অর্জিত হতে পারে?” এ সময়ই শ্রীকৃষ্ণ তাকে গীতার মাধ্যমে জীবনের মৌলিক দর্শন বোঝান।

“ক্লৈব্যং মা স্ম গমঃ পার্থ নৈতত্ত্বয়্যুপপদ্যতে।
ক্ষুদ্রং হৃদয়দৌর্বল্যং ত্যক্ত্বোত্তিষ্ঠ পরন্তপ।”
(গীতা, ২.৩)
অর্থাৎ, “হে পার্থ, দুর্বলতা তোমার জন্য মানানসই নয়। হৃদয়ের ছোটত্ব ত্যাগ করো এবং উঠে দাঁড়াও।”

আমার মনে হয়, আপনি যদি কখনো জীবন নিয়ে হতাশা বোধ করেন, অর্জুনের এই দোলাচলের সঙ্গে নিজেকে তুলনা করতে পারবেন। তবে এখানেই শেষ নয়। শ্রীকৃষ্ণ তাকে শুধু আশ্বাস দেননি, তাকে জীবনের গভীরতর উদ্দেশ্য সম্পর্কে জ্ঞান দিয়েছেন।

গীতার শিক্ষা এবং জীবনের পথ

গীতার মূলমন্ত্র হলো “নিশ্কাম কর্ম”, অর্থাৎ ফলের আসক্তি ত্যাগ করে নিজের কর্তব্য পালন করা। শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলেন:
“কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন।”
(গীতা, ২.৪৭)
অর্থাৎ, “তোমার কর্তব্য হলো কাজ করা, কিন্তু ফলের আশা করা তোমার অধিকার নয়।”

এটি কি এক মুহূর্তের জন্য আপনাকে থামিয়ে ভাবতে বাধ্য করে না? আমরা প্রতিনিয়ত আমাদের কাজের ফল নিয়ে চিন্তিত থাকি। কিন্তু যদি আমরা গীতার এই শিক্ষাকে মেনে চলি এবং আমাদের কাজকে শ্রদ্ধার সঙ্গে সম্পন্ন করি, তবে আমরা নিজেকে দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত করতে পারি।

আমার জীবনের একটি ঘটনা এখানে উল্লেখ করতে চাই। একসময় আমি একটি বড় প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করছিলাম। কাজটি খুব কঠিন ছিল এবং আমি ফলাফল নিয়ে এতটাই চিন্তিত ছিলাম যে কাজের প্রতি আনন্দ হারিয়ে ফেলেছিলাম। তখন গীতার এই শ্লোক আমাকে মনে করিয়ে দিল, “কাজ করো, কিন্তু ফলের আশা করো না।” আমি যখন এটি মেনে চলতে শুরু করলাম, তখন কাজটি সহজ লাগতে শুরু করল এবং শেষ পর্যন্ত ফলাফলও ভালো হল। এটি অর্জুনের মতো আমাকে শিক্ষা দিয়েছিল যে সুখ কাজের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে, ফলাফলের মধ্যে নয়।

জীবনের কঠিন সময়ে মানসিক শান্তি

গীতার আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হলো “সমত্ববুদ্ধি”, অর্থাৎ সুখ-দুঃখ, লাভ-ক্ষতি, জয়-পরাজয়—এই সবকিছুর প্রতি সমান দৃষ্টিভঙ্গি রাখা। শ্রীকৃষ্ণ বলেন:
“সমং দুঃখসুখং ধীরং সঃ অমৃতত্বায় কল্পতে।”
(গীতা, ২.১৫)
অর্থাৎ, “যিনি সুখ-দুঃখে অবিচল থাকেন, তিনিই প্রকৃত মুক্তির যোগ্য।”

এটি জীবনে প্রয়োগ করা কঠিন, তবে অসম্ভব নয়। আমি জানি, আপনি অনেক সময় কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হন। তখন যদি আপনি নিজের মনকে স্থির রাখতে পারেন এবং নিজেকে বলেন যে “এটা সাময়িক,” তবে আপনি মানসিক শান্তি খুঁজে পাবেন।

অর্জুনের শিক্ষা থেকে আমাদের জীবনের অনুপ্রেরণা

শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা দেন: “ভক্তি ও বিশ্বাস।” তিনি বলেন:
“যো যো যাং যাং তনুম্ভক্তঃ শ্রদ্ধয়াচ্ছতি।”
(গীতা, ৭.২১)
অর্থাৎ, “যে যেমন বিশ্বাস করে, সে তেমনই প্রাপ্ত হয়।”

এটি আমাদের দেখায় যে, বিশ্বাস ও ভক্তির মাধ্যমে আমরা জীবনে যে কোনো বাধা অতিক্রম করতে পারি। অর্জুন যদি কৃষ্ণের প্রতি অগাধ বিশ্বাস না রাখতেন, তবে তিনি হয়তো কখনোই যুদ্ধক্ষেত্রে আত্মবিশ্বাস ফিরে পেতেন না।

আমার একটি প্রিয় উক্তি হল, “বিশ্বাস ছাড়া কোনো কিছু সম্ভব নয়।” যদি আমরা নিজের ক্ষমতার প্রতি বিশ্বাস রাখতে পারি, তবে পৃথিবীর কোনো বাধা আমাদের থামাতে পারবে না।

সুখের শেষ কথা

অর্জুনের গীতার শিক্ষায় সুখ খুঁজে পাওয়া মানে আমাদের মনকে প্রশান্ত করা, আমাদের কর্তব্য পালন করা, এবং জীবনকে সমান দৃষ্টিতে দেখা। গীতার প্রতিটি শ্লোক যেন আমাদের জীবনের জন্য একটি মাইলফলক।

আপনার জীবনে কোনো সংকট এলে, গীতার এই শিক্ষাগুলি কি আপনাকে সমাধান দিতে পারবে না? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে আপনি হয়তো নিজের মধ্যে সুখের সন্ধান পাবেন। মহাভারত আমাদের শেখায় যে সুখ বাহ্যিক নয়, এটি আমাদের অন্তরের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top