অর্জুন যুদ্ধ করার আগে যে দ্বিধায় ভুগেছিলেন তা কীভাবে সমাধান করা হয়েছিল?

আপনি কখনও এমন পরিস্থিতিতে পড়েছেন, যেখানে আপনার সামনে কঠিন একটি সিদ্ধান্ত নিতে হয়, কিন্তু মন বারবার দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে? এমন মুহূর্তে আপনাকে একটি পথপ্রদর্শকের প্রয়োজন হয়, যিনি আপনাকে সঠিক দিকনির্দেশনা দিতে পারেন। মহাভারতের অর্জুনের অবস্থা ঠিক এমনই ছিল। যুদ্ধে যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে, নিজের প্রিয়জনদের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলতে হবে, এই ভেবে তিনি গভীর সংকটে পড়েছিলেন। এই সংকটই আমাদের জীবনের অনেক কঠিন সময়ের সাথে মেলে।

অর্জুনের দ্বিধা: কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ

যুদ্ধের ময়দানে দাঁড়িয়ে অর্জুন যখন তার ভাই, পিতা-তুল্য ভীষ্ম, এবং শিক্ষাগুরু দ্রোণাচার্যের মুখোমুখি হলেন, তখন তার মন এক গভীর দোলাচলে পড়ে। তিনি নিজেকে প্রশ্ন করেন: “আমি কি আমার প্রিয়জনদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পারি? ন্যায়ের জন্যও কি তাদের হত্যা করা সঠিক হবে?”

অর্জুন তখন শ্রীকৃষ্ণের কাছে বলেছিলেন:

“ধর্মসংমূঢ়চেতাঃ স্মৃতি ভূর্‌ণাম্ চ যচ্ছত।”

(গীতা, ২.৭) – আমি ধর্মের বিষয়ে বিভ্রান্ত। আমি কী করব, তা বুঝতে পারছি না।

অর্জুনের এই কথায় বোঝা যায়, তিনি নিজের কর্তব্য এবং সম্পর্কের মধ্যে ভারসাম্য আনতে পারছিলেন না। এই দ্বিধা তাকে এক ধরণের মানসিক অস্থিরতায় নিয়ে যায়।

শ্রীকৃষ্ণের দিকনির্দেশনা: গীতার জ্ঞান

অর্জুনের এই সংকটময় অবস্থায় শ্রীকৃষ্ণ তাকে যে দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন, তা শুধুমাত্র যুদ্ধক্ষেত্রের জন্য নয়, আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সমস্যাগুলো সমাধানের জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শ্রীকৃষ্ণ বলেন:

“ক্লৈব্যং মা স্ম গমঃ পার্থ নৈতত্ত্বয়্যুপপদ্যতে।”

(গীতা, ২.৩) – হে পার্থ, তোমার এই দুর্বলতা তোমার জন্য সম্মানজনক নয়। এটি ত্যাগ কর।

শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে তার কর্তব্য স্মরণ করিয়ে দেন। তিনি অর্জুনকে বোঝান যে, একজন ক্ষত্রিয়ের জন্য ধর্ম অনুযায়ী যুদ্ধ করা তার জীবনের প্রধান লক্ষ্য।

জীবনের শিক্ষা: কর্মযোগের ধারণা

শ্রীকৃষ্ণ গীতার মাধ্যমে অর্জুনকে কর্মযোগের শিক্ষা দেন। তিনি বলেন:

“কর্মণ্যেঽধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন।”

(গীতা, ২.৪৭) – তোমার কর্তব্য কর্ম করে যাও, ফলের চিন্তা করো না।

এই উপদেশে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বোঝান যে, আমাদের কাজ করা উচিত সঠিক কারণের জন্য, এবং তার ফল নিয়ে চিন্তিত হওয়া উচিত নয়।

অফিসের দায়িত্ব

আপনার অফিসের কোনও কঠিন প্রকল্প যদি আপনাকে দেওয়া হয়, আপনি কি তখন নিজের দক্ষতাকে নিয়ে সন্দেহ করেন? অনেক সময় আমরা ফলাফল নিয়ে এতটাই চিন্তিত হয়ে পড়ি যে, কাজ শুরু করার আগেই ভয় পাই। কিন্তু যদি আপনি কর্মযোগের এই নীতিটি অনুসরণ করেন, তাহলে আপনি শুধুমাত্র নিজের কাজে মনোযোগ দিতে পারবেন।

পারিবারিক সমস্যার সমাধান

কখনও পারিবারিক ঝামেলার সময় আপনাকে এমন সিদ্ধান্ত নিতে হয় যা একদিকে ন্যায়সঙ্গত, অন্যদিকে আবেগকে আঘাত করে। সেই মুহূর্তে শ্রীকৃষ্ণের মতো একজন গাইডের প্রয়োজন হয়, যিনি আপনাকে সঠিক পথ দেখাবেন।

জ্ঞানযোগ: নিজেকে চিনতে শেখা

শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা দেন, যা হল জ্ঞানযোগ। তিনি বলেন:

“ন হি জ্ঞানেন সদৃশং পবিত্রমিহ বিদ্যতে।”

(গীতা, ৪.৩৮) – এই পৃথিবীতে জ্ঞানের চেয়ে পবিত্র কিছু নেই।

অর্জুনকে বোঝানো হয়, তিনি শুধু শরীর নন, তিনি আত্মা। এই আত্মা চিরন্তন এবং অবিনশ্বর। এই জ্ঞান অর্জুনের ভিতরের ভয় এবং সংকটকে দূর করে।

শিক্ষার গুরুত্ব

আমাদের জীবনের অনেক সমস্যার মূল কারণ হল অজ্ঞতা। যখন আপনি কোনও বিষয়ে জ্ঞান লাভ করেন, তখন সেই সমস্যা অনেকটাই সহজ হয়ে যায়। উদাহরণস্বরূপ, পরীক্ষার আগে প্রস্তুতি ভালো থাকলে আমরা অনেকটাই আত্মবিশ্বাসী বোধ করি।

ভক্তিযোগ: ঈশ্বরের প্রতি সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ

অর্জুনের সংকট সমাধানের আরেকটি পথ হল ভক্তিযোগ। শ্রীকৃষ্ণ বলেন:

“তদ্বিদ্ধি প্রণিপাতেন পরিব্রশ্নেন সেবয়া।”

(গীতা, ৪.৩৪) – জ্ঞান অর্জনের জন্য, ভক্তি এবং সেবার মনোভাব থাকতে হবে।

ভক্তির মাধ্যমে অর্জুন শ্রীকৃষ্ণের প্রতি পূর্ণ আস্থা স্থাপন করেন। এই আস্থা তাকে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে।

জীবনের চ্যালেঞ্জে ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস

জীবনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় অনেক সময় আমাদের শুধুমাত্র ঈশ্বরের প্রতি আস্থা রাখতে হয়। এটি আমাদের মানসিক শান্তি এবং শক্তি দেয়।

সংকট থেকে মুক্তি: অর্জুনের সিদ্ধান্ত

গীতার শিক্ষা অর্জুনের মনের সমস্ত দ্বিধা দূর করে। তিনি উপলব্ধি করেন যে, ন্যায়ের জন্য লড়াই করা তার কর্তব্য। শ্রীকৃষ্ণের নির্দেশনা অনুসরণ করে তিনি আবার তার ধনুকে হাত রাখেন এবং যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হন।

শ্রীকৃষ্ণের শেষ উপদেশ ছিল:

“সর্বধর্মান পরিত্যজ্য মামেকং শরণং ব্রজ।”

(গীতা, ১৮.৬৬) – সমস্ত ধর্ম ত্যাগ করে শুধুমাত্র আমার শরণাপন্ন হও। আমি তোমাকে সমস্ত পাপ থেকে মুক্ত করব।

দ্বিধা থেকে দৃঢ়তার পথে

আপনার জীবনেও যদি কখনও অর্জুনের মতো পরিস্থিতি আসে, মনে রাখবেন, সমাধান শ্রীকৃষ্ণের গীতার মধ্যেই রয়েছে। জ্ঞান, কর্ম, এবং ভক্তির সমন্বয় আপনাকে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করবে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top