আপনারা কি কখনও ভেবেছেন, সুখ কোথা থেকে আসে? এটা কি বাহ্যিক বস্তু থেকে, না কি অন্তরের কোনো গভীর অংশ থেকে? মহাভারত, হিন্দু ধর্মের এক মহাকাব্য, আমাদের এই প্রশ্নের উত্তর দেয়। এই মহাগ্রন্থে আত্মা এবং সুখের সম্পর্ক অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে, যা আমাদের জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে দিশা দেখাতে পারে।
সুখের প্রকৃতি এবং আত্মার ভূমিকা
মহাভারতের একাধিক অংশে আত্মার প্রকৃতি এবং সুখের উৎস নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। ভীষ্ম পিতামহ যখন শয্যাগত অবস্থায় যুধিষ্ঠিরকে জ্ঞান দিচ্ছিলেন, তখন তিনি বলেন:
“সুখমনন্তরমন্যদৈহিকং দুঃখমবিনাশিনঃ।”
(মহাভারত, শান্তি পর্ব)
অর্থাৎ, “দেহগত সুখ এবং দুঃখ সাময়িক, কিন্তু আত্মা অমর এবং অবিনশ্বর।”
আমাদের দৈনন্দিন জীবনে আমরা প্রায়ই বাহ্যিক বস্তু থেকে সুখের সন্ধান করি—টাকা, সম্পদ, খ্যাতি। কিন্তু মহাভারত জানায়, আত্মা হলো প্রকৃত সুখের উৎস। বাহ্যিক বিষয় সাময়িক আনন্দ দিতে পারে, কিন্তু অভ্যন্তরীণ শান্তি আসে কেবল আত্মার সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করলে।
অর্জুনের দ্বিধা এবং তার সমাধান
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধক্ষেত্রে অর্জুন যখন দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে, তখন শ্রীকৃষ্ণ তাকে বলেন:
“আত্মানং রথিনং বিদ্ধি শরীরং রথমেব চ।”
(ভগবদ্গীতা, অধ্যায় ৬)
অর্থাৎ, “তুমি আত্মাকে রথচালক হিসেবে এবং শরীরকে রথ হিসেবে ভাব। আত্মা-নির্ভর হলে তুমি সুখ এবং শান্তি অর্জন করতে পারবে।”
অর্জুন তার আত্মার প্রকৃত শক্তি উপলব্ধি করেই নিজের দ্বিধা দূর করতে পেরেছিল। এ থেকে আমরা শিখি, জীবনের প্রতিটি সমস্যার সমাধান আমাদের অন্তরে লুকিয়ে থাকে।
যুধিষ্ঠিরের ন্যায়নীতি এবং সুখ
যুধিষ্ঠির, ধর্মপুত্র নামে পরিচিত, তার জীবনের প্রতিটি সিদ্ধান্তে ধর্মের পথ অনুসরণ করেছেন। একবার যখন দুর্যোধন তাঁকে এক মায়াজালে ফাঁসিয়ে দেয়, তখনও তিনি শান্ত এবং দৃঢ় থাকেন। তিনি বিশ্বাস করতেন:
“ধর্মঃ সুখস্য মূলং।”
(মহাভারত, বনপর্ব)
অর্থাৎ, “ধর্মই সুখের মূল।”
আপনারা যদি জীবনের সুখ খুঁজতে চান, তাহলে নিজের ধর্মকে মেনে চলুন। ধর্ম মানে কেবল পূজা-অর্চনা নয়; এটি হল ন্যায়, সত্য এবং মানবতাকে শ্রদ্ধা করা।
কর্ণের আত্মত্যাগ এবং সুখ
কর্ণ, এক মহাবীর, সুখের প্রকৃত অর্থ খুঁজে পেয়েছিলেন আত্মত্যাগের মাধ্যমে। নিজের পরিচয়ের লজ্জা এবং জীবনের অগণিত প্রতিকূলতার মাঝেও কর্ণ সর্বদা দানশীল এবং সদয় ছিলেন। একবার তিনি বলেছিলেন:
“সুখম্ দানেন সম্প্রাপ্তম্।”
(মহাভারত, উদ্যোগ পর্ব)
অর্থাৎ, “দান করার মাধ্যমে যে সুখ অর্জন হয়, তা অন্য কিছু দিয়ে সম্ভব নয়।”
আমরা প্রায়ই নিজের জন্য চিন্তা করি, কিন্তু মহাভারত আমাদের শেখায়, প্রকৃত সুখ অন্যের কল্যাণে কাজ করার মাধ্যমে অর্জন হয়।
দ্রৌপদীর অন্তরের শক্তি
দ্রৌপদী, কৌরবদের হাতে অপমানিত হলেও, কখনোই তাঁর আত্মবিশ্বাস হারাননি। নিজের আত্মার শক্তি এবং ভগবানের উপর বিশ্বাস তাকে কঠিন সময়ে সাহস জোগায়। যখন তিনি কৃষ্ণকে ডাকেন, তখন তাঁর প্রার্থনা থেকে বোঝা যায়:
“অন্তঃ সুখম্ শরণং কৃষ্ণে।”
অর্থাৎ, “আত্মার সুখের প্রকৃত আশ্রয় ভগবান কৃষ্ণ।”
দ্রৌপদীর এই উদাহরণ আমাদের শেখায়, প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও আত্মার শক্তি আমাদের রক্ষা করতে পারে।
সুখের জন্য মহাভারতের বার্তা
মহাভারত আমাদের জানায়, সুখ কেবল বাহ্যিক জগৎ থেকে আসে না; এটি আমাদের অন্তর থেকে আসে। আত্মার সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে হলে ধ্যান, যোগ এবং আত্মচিন্তনের প্রয়োজন। এই গ্রন্থের প্রতিটি শ্লোক আমাদের বলে, জীবন কতটা অস্থায়ী, এবং আত্মাই একমাত্র স্থায়ী সত্য।
যেমন, ভীষ্ম পিতামহ শান্তি পর্বে বলেন:
“সর্বং সুখম্ আত্মানন্দে।”
অর্থাৎ, “প্রকৃত সুখ আত্মার আনন্দে।”
আপনার জীবনে মহাভারতের শিক্ষা
আপনার জীবনেও কি কখনো মনে হয় যে সুখ যেন ধরা দিচ্ছে না? মহাভারতের এই শিক্ষাগুলি আপনাকে সাহায্য করতে পারে। আত্মার সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করুন, ধর্মপথে চলুন, এবং নিজের বিশ্বাসের উপর অটল থাকুন। মনে রাখবেন, সুখ বাহ্যিক নয়; এটি আপনার অন্তরের গভীরে লুকিয়ে আছে।
শেষ কথা
মহাভারত আমাদের জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে পথ দেখাতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, আমরা কি আত্মার সত্যিকারের শক্তি অনুভব করতে প্রস্তুত?
“আপনি কি আপনার জীবনে আত্মার শক্তি ব্যবহার করে প্রকৃত সুখ অর্জন করতে চান?”
ভাবুন, আর মহাভারতের দিশা নিয়ে আপনার জীবনে এগিয়ে চলুন।