মহাভারত আমাদের জীবনের একটি আয়না। এতে থাকা গল্পগুলো শুধু ইতিহাস নয়, আমাদের প্রতিদিনের জীবনের নানা দিকের প্রতিফলন। একলব্যের কাহিনী সেইসব কাহিনীর মধ্যে অন্যতম, যা আমাকে বারবার ভাবতে বাধ্য করে। তুমি যদি একবারও মহাভারতের এই অংশটি পড়ে থাকো, তাহলে নিশ্চয়ই বুঝতে পারবে, এটি শুধু শ্রেণি বৈষম্যের কথা নয়, বরং লিঙ্গ বৈষম্যের দিকেও আমাদের নজর দিতে শেখায়।
একলব্য, একজন নিষাদ রাজপুত্র, গুরু দ্রোণাচার্যের কাছে শিখতে চেয়েছিল। কিন্তু দ্রোণাচার্য তাকে শিক্ষা দিতে অস্বীকার করেন, কারণ তিনি ছিলেন নিষাদ। শ্রেণি বৈষম্যের এই দৃষ্টান্ত স্পষ্ট। কিন্তু এই কাহিনী শুধুমাত্র এখানে শেষ হয় না। যদি গভীরে তাকাও, তাহলে দেখতে পাবে এই কাহিনীতে লিঙ্গ বৈষম্যেরও স্পষ্ট উদাহরণ রয়েছে।
শ্রেণি বৈষম্য: একলব্যের ত্যাগ
“অঙ্গুষ্ঠ দান”—এই শব্দযুগল যখনই শুনি, তখনই মনে পড়ে একলব্যের কথা। একলব্য, যিনি নিজের অঙ্গুষ্ঠ কেটে দ্রোণাচার্যকে দান করেছিলেন, শুধুমাত্র নিজের শিক্ষার জন্য। তার শিক্ষা প্রাপ্তির পথে শ্রেণি ছিল প্রধান বাঁধা। নিষাদ রাজপুত্র হওয়ার কারণে দ্রোণাচার্য তাকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।
এখন ভাবো, যদি তুমি একলব্যের জায়গায় থাকতে, তাহলে কী করতে? একলব্য কিন্তু হাল ছাড়েনি। তিনি নিজের মূর্তি বানিয়ে সেই মূর্তিকে গুরু হিসেবে পূজা করে শিক্ষা নিয়েছিলেন। তার এই অধ্যবসায় আমাদের শেখায়, শ্রেণি বাধা হলেও জ্ঞানার্জন কখনও থেমে থাকতে পারে না।
তবে, এখানে প্রশ্ন আসে, কেন একলব্যকে শিক্ষার অধিকার দেওয়া হয়নি? শুধু তার নিষাদ পরিচয়ের কারণে? দ্রোণাচার্য সেই সময়ের সমাজের প্রতিচ্ছবি। আজও আমরা দেখতে পাই, শিক্ষা বা কাজের ক্ষেত্রে শ্রেণি নিয়ে বৈষম্য করা হয়।
লিঙ্গ বৈষম্যের ছায়া
এবার আসি কাহিনীর আরেকটি দিক—লিঙ্গ বৈষম্য। একলব্যের কাহিনী যদি গভীরভাবে দেখো, তাহলে বুঝতে পারবে, শুধু শ্রেণি নয়, লিঙ্গও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মহাভারতের কালে নারীদের শিক্ষা ও যুদ্ধকৌশল শেখার অধিকার সীমিত ছিল। দ্রৌপদী বা কুন্তীর মতো নারীরা তাদের নিজস্ব ভূমিকা পালন করলেও, তাদের সীমাবদ্ধতাও ছিল স্পষ্ট।
মনে করো, একলব্য যদি একজন নারী হতো, তাহলে কী ঘটত? নারী হওয়ার কারণে তাকে আরও বেশি বাধার সম্মুখীন হতে হতো। দ্রোণাচার্য হয়তো তাকে আরও কঠোরভাবে প্রত্যাখ্যান করতেন। এমনকি, নিজের মূর্তি বানিয়ে শিখতে চাইলেও, সমাজ হয়তো তাকে সমর্থন করত না। এই কাহিনী শুধু একলব্যের নয়, এটি প্রতিটি সেই ব্যক্তির, যে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে বাধা পায়।
মহাভারতের নারীরা: উদাহরণ ও বাস্তবতা
তুমি নিশ্চয়ই দ্রৌপদীর কথা জানো। দ্রৌপদী, যিনি তার পাঁচ স্বামীকে একত্রে ধরে রেখেছিলেন, কিন্তু তিনিও পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বেড়াজালে বন্দী ছিলেন। তার অপমান, যা কৌরব সভায় ঘটেছিল, সেই সময়ের নারীদের প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরে।
আরেকটি উদাহরণ হলো কুন্তী। তিনি নিজেও অনেক শক্তিশালী ছিলেন, কিন্তু তার ইচ্ছা বা মতামত সব সময় গুরুত্ব পায়নি। মহাভারতে নারী চরিত্ররা তাদের জ্ঞান বা শক্তির কারণে নয়, বরং তাদের সঙ্গে যুক্ত পুরুষদের কারণে পরিচিত।
তুমি যদি নিজের জীবনে মহাভারতের আদর্শ মেনে চলতে চাও, তাহলে এই উদাহরণগুলো থেকে শিক্ষা নিতে পারো। সমাজে পরিবর্তন আনার জন্য তোমাকে যেমন একলব্যের মতো অধ্যবসায়ী হতে হবে, তেমনি দ্রৌপদী বা কুন্তীর মতো নিজের অধিকারের জন্য লড়তে হবে।
মহাভারতের শিক্ষার প্রাসঙ্গিকতা
মহাভারত আমাদের শেখায় যে বৈষম্য শুধু সমাজের একটি দিক নয়, এটি আমাদের চিন্তার অংশ। “ধর্মক্ষেত্রে কুরুক্ষেত্রে”—এই বাক্য যেমন যুদ্ধক্ষেত্রের প্রতীক, তেমনই আমাদের জীবনের প্রতিদিনের সংগ্রামেরও। তুমি যদি এই সংগ্রামে জয়লাভ করতে চাও, তাহলে বৈষম্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে।
একটি উদাহরণ হলো অর্জুন। তিনি সব সময় তার লক্ষ্য পূরণের জন্য অধ্যবসায়ী ছিলেন। তুমি যদি অর্জুনের মতো নিজের লক্ষ্যে স্থির থাকো, তাহলে সমাজের বাধা তোমাকে আটকাতে পারবে না। একইভাবে, একলব্যের কাহিনী আমাদের শেখায়, বাধা যত বড়ই হোক না কেন, অধ্যবসায় দিয়ে সবকিছু সম্ভব।
নতুন যুগে পুরনো সমস্যার সমাধান
আজকের সমাজে আমরা কীভাবে মহাভারতের এই শিক্ষাগুলো প্রয়োগ করতে পারি? প্রথমত, শ্রেণি ও লিঙ্গ বৈষম্যের বিরুদ্ধে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। যদি তুমি কোনো প্রতিষ্ঠানে কাজ করো, সেখানে সবার প্রতি সমান আচরণ করো।
দ্বিতীয়ত, নিজেদের মধ্যে একলব্যের মতো আত্মবিশ্বাস তৈরি করতে হবে। সমাজ তোমাকে যাই বলুক না কেন, তুমি যদি নিজের ক্ষমতার ওপর ভরসা রাখো, তাহলে কোনো বাধাই স্থায়ী হবে না।
তৃতীয়ত, নারীদের জন্য আরও বেশি সুযোগ তৈরি করতে হবে। আমাদের মহাভারতের শিক্ষা অনুযায়ী চলতে হলে, নারীদের শক্তি ও ক্ষমতাকে সম্মান জানাতে হবে।
শেষ কথা
মহাভারতের একলব্যের কাহিনী শুধু একটি গল্প নয়; এটি আমাদের জীবনের একটি পাঠ। শ্রেণি ও লিঙ্গ বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গেলে, আমাদের প্রত্যেককে একলব্যের মতো সাহসী হতে হবে। তুমি কি একলব্যের মতো নিজের লক্ষ্যে স্থির থাকতে পারবে? কিংবা দ্রৌপদীর মতো নিজের অধিকারের জন্য লড়তে পারবে?
মহাভারতের এই প্রশ্নগুলো শুধু আমাদের অতীত নয়, আমাদের ভবিষ্যতেরও দিশা দেখায়। তুমি যদি এই আদর্শ মেনে চল, তাহলে তোমার জীবন শুধু উন্নতই হবে না, তুমি সমাজে পরিবর্তন আনতে পারবে। তাহলে, তুমি কি প্রস্তুত একলব্যের মতো হতে?