কর্ণ, মহাভারতের অন্যতম জটিল এবং বেদনাদায়ক চরিত্র। তার জীবন মানেই এক অনন্ত দ্বন্দ্ব—ধর্ম ও কর্তব্যের মধ্যে, আত্মসম্মান ও বন্ধুত্বের মধ্যে। কর্ণের জীবনের এই দ্বন্দ্ব আমাদের অনেককেই ভীষণভাবে অনুপ্রাণিত করে, কারণ আমরা নিজেদের জীবনে একইরকম মানসিক টানাপড়েনের সম্মুখীন হই।
কর্ণের পরিচয় এবং আত্মসম্মানের উত্থান
কর্ণ ছিলেন সূর্যদেব এবং কুন্তীর পুত্র। কিন্তু তিনি বড় হয়েছেন একজন রথচালকের পুত্র হিসেবে। কুন্তীর গোপনীয়তার কারণে তার রাজপুত্র পরিচয় কেউ জানত না। এই পরিচয়হীনতাই কর্ণের জীবনে এক অদ্ভুত অপূর্ণতা এবং চিরস্থায়ী যন্ত্রণা তৈরি করে। কর্ণ নিজেকে বারবার প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু সমাজের চোখে তার জন্ম পরিচয়ই তার আত্মসম্মানের পথে প্রধান অন্তরায় ছিল।
মহাভারতের একটি বিখ্যাত শ্লোক বলছে:
“ধর্ম্যাৎ ন হীনম্ কুরুতে অপথং যঃ।
স চ ধর্মম্ প্রাপ্ত নাতি ভাবেন কর্মফলে।”
(অর্থাৎ, যে ব্যক্তি নিজেকে ধর্ম থেকে বঞ্চিত করে না, সে কখনো ভুল পথে যায় না। তার কর্মের ফল নিয়েও সে অতিরিক্ত ভাবিত হয় না।)
কর্ণের জীবনে এই শ্লোকের ব্যাখ্যা যেন উল্টো পথে গেছে। তিনি সবসময় নিজেকে সমাজের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু নিজের অবস্থান সম্পর্কে আত্মসচেতন থেকেছেন।
কর্ণের জীবনের প্রধান দ্বন্দ্ব
তোমাকে যদি এমন পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হয় যেখানে তোমার বন্ধুত্ব এবং নিজের আত্মসম্মানের মধ্যে কোনো একটি বেছে নিতে হয়, তুমি কী করবে? কর্ণের জীবনে এই প্রশ্নটাই বারবার ফিরে এসেছে। দ্রৌপদীর সভায় যখন তাকে “সুতপুত্র” বলে অপমান করা হয়েছিল, তখন তার ভেতরে রাগ এবং অপমানের আগুন জ্বলছিল।
কর্ণ তখন দুর্যোধনের প্রতি কৃতজ্ঞতার জন্য দ্রৌপদীর প্রতি কঠোর হন। তিনি বলেছিলেন:
“যে ব্যক্তি আমাকে সম্মান দিয়েছে, তার জন্য আমি আমার জীবনের সব কিছু ত্যাগ করতেও প্রস্তুত।”
এই উক্তি আমাদের শেখায় বন্ধুত্বের প্রতি আনুগত্যের গভীরতা। কিন্তু কর্ণের এই আনুগত্যই তার জীবনের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হয়ে দাঁড়ায়।
কর্ণ এবং কৃষ্ণের কথোপকথন
যুদ্ধ শুরুর আগে কৃষ্ণ কর্ণের কাছে আসেন এবং তার সত্য পরিচয় জানান। কৃষ্ণ কর্ণকে অনুরোধ করেন, “পাণ্ডবদের সাথে যোগ দাও। তারা তোমার ভাই। তুমি যদি তাদের সাথে থাকো, তবে যুদ্ধ তোমার জন্য বিজয়ী হবে।” কিন্তু কর্ণের উত্তর ছিল হৃদয়বিদারক:
“আমি দুর্যোধনের লব্ধ সম্মান পেয়েছি, আমি তার ঋণী। আমি তার পক্ষে লড়াই করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।”
কর্ণ জানতেন যে, তিনি দুর্যোধনের পক্ষে থাকলে তার মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। তবুও, তিনি তার বন্ধুত্বের প্রতি অটল ছিলেন। এই উত্তর আমাদের এক অনন্ত প্রশ্নের মুখোমুখি করে—নিজের আত্মসম্মানের জন্য কি আমরা অন্যায়কে সমর্থন করব?
কর্ণের মানসিক প্রভাব
তুমি কি কখনো এমন অনুভব করেছ যে, তুমি যা করছ তা ঠিক, কিন্তু সমাজ তোমাকে বোঝে না? কর্ণ এই যন্ত্রণাই বারবার সহ্য করেছেন। সমাজ তাকে ‘সুতপুত্র’ বলে অপমান করেছে, অথচ তার বীরত্ব এবং দানশীলতার তুলনা ছিল না। মহাভারতে বলা হয়েছে:
“দানশীলতায় কর্ণের তুলনা হয় না।”
তার মানসিক দ্বন্দ্বের সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলো নিজের মা কুন্তীকে ক্ষমা করা। যুদ্ধের আগে কুন্তী যখন কর্ণের কাছে তার প্রকৃত পরিচয় প্রকাশ করেন, তখন কর্ণ বলেন:
“মা, আমি তোমাকে ক্ষমা করি, কিন্তু আমি আমার প্রতিজ্ঞা থেকে সরে আসতে পারব না।”
কর্ণের থেকে আমরা কী শিখব?
আমাদের জীবনে কর্ণের মতো অনেক মুহূর্ত আসে, যখন আত্মসম্মান, বন্ধুত্ব, এবং কর্তব্যের মধ্যে একটি বেছে নিতে হয়। কর্ণের জীবন আমাদের শেখায়, আত্মসম্মানবোধই মানুষের সবচেয়ে বড় সম্পদ। কিন্তু একইসাথে এটি আমাদের সতর্ক করে দেয়—আত্মসম্মান রক্ষার জন্য অন্যায়ের পথ বেছে নিলে এর ফল ভয়ঙ্কর হতে পারে।
উপসংহার
কর্ণের আত্মসম্মানবোধের দ্বন্দ্ব এবং এর মানসিক প্রভাব আমাদের জীবনের প্রতিচ্ছবি। আমরা কর্ণের মতো কখনো বন্ধুত্বের প্রতি আনুগত্য দেখাই, কখনো নিজের পরিচয়ের জন্য সংগ্রাম করি। কর্ণের জীবন আমাদের এই প্রশ্নে নিয়ে আসে—তুমি কি নিজের আত্মসম্মানের জন্য সবকিছু ত্যাগ করতে প্রস্তুত? নাকি তুমি অন্যের জন্য নিজের নীতির সাথে আপস করবে?