মহাভারত আমাদের জীবনযাপনের এক অনন্য দিশা দেখায়। আপনি যদি মন দিয়ে এর চরিত্রদের দেখেন, তাদের আচরণ বিশ্লেষণ করেন, তবে আপনার জীবনকেও অনেকাংশে উন্নত করতে পারেন। আজ আমি কথা বলব কর্ণকে নিয়ে, যে চরিত্রটি আজও আমাদের হৃদয়ে বেদনার সুর তোলে। কর্ণের পরিচয় নিয়ে সমাজের অবজ্ঞা কি সত্যিই তার উপর একধরনের মানসিক অত্যাচার ছিল? আসুন, আমি এবং আপনি একসঙ্গে এই প্রশ্নের গভীরে প্রবেশ করি।
কর্ণের পরিচয়ের সংকট
কর্ণের জীবন শুরু থেকেই একটি অদ্ভুত দ্বন্দ্বে জড়ানো। সে জন্মসূত্রে কুন্তীর পুত্র হলেও, তাকে বড় হতে হয়েছিল রাধা ও অধিরথের পুত্র হিসেবে। এই পরিচয়ের দ্বন্দ্ব তাকে বারবার সমাজের সামনে অপমানিত হতে বাধ্য করেছিল। কৌরব সভায় দ্রৌপদী যখন বলেছিলেন, “সুতপুত্র কর্ণকে আমি বিয়ে করব না,” তখন কর্ণ শুধু দ্রৌপদীর প্রত্যাখ্যান নয়, পুরো সমাজের অবজ্ঞার শিকার হয়েছিল। এমন অপমান কি একজন মানুষের আত্মবিশ্বাস ভেঙে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়?
গুরু পরশুরামের শাপ
গুরু পরশুরাম কর্ণকে ব্রাহ্মণ মনে করে অস্ত্রবিদ্যা শিক্ষা দিয়েছিলেন। কিন্তু যখন কর্ণের পরিচয় প্রকাশিত হয়, তিনি কর্ণকে অভিশাপ দেন, “যুদ্ধের সময় তুমি তোমার শিক্ষার মূল মন্ত্র ভুলে যাবে।” এটি শুধুমাত্র এক গুরু-শিষ্যের সম্পর্কের অবসান নয়, বরং কর্ণের জীবনের এক বিশাল আঘাত। সমাজ কীভাবে একজনের জন্মপরিচয়কে তার চরিত্রের উপরে স্থান দেয়, এই ঘটনাটি তার উদাহরণ।
মহাভারতে একটি স্থানে বলা হয়েছে, “ধর্মং যৎ সত্যং তৎ কৌরব্য।” অর্থাৎ, সত্যই ধর্ম। কিন্তু সমাজ কর্ণের সত্যকে কখনোই মেনে নিতে পারেনি। তার জীবনের সত্যই তাকে বারবার মানসিক অত্যাচারের শিকার করেছে।
দ্রোণাচার্যের পক্ষপাত
কর্ণ যখন দ্রোণাচার্যের কাছে গিয়ে বলেছিল, সে তার শিষ্য হতে চায়, তখন দ্রোণ তাকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেন। কারণ কর্ণ “সুতপুত্র”। এটি কি ন্যায়? আপনি কি কল্পনা করতে পারেন, শুধুমাত্র সামাজিক পরিচয়ের কারণে আপনার প্রতিভাকে অগ্রাহ্য করা হচ্ছে? আমি জানি, আপনি এবং আমি এই অনুভূতির সাথে একাত্ম হতে পারি।
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের সময় অপমান
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে কর্ণের সাথে সর্বদা একটি প্রশ্ন জড়িয়ে ছিল: “তুমি কি আসলেই একজন ক্ষত্রিয়?” ভীষ্ম, দ্রোণ এবং এমনকি কুন্তী, সবাই তাকে এই প্রশ্নের সম্মুখীন করিয়েছে। একবার ভীষ্ম কর্ণকে বলেছিলেন, “তুমি সুতপুত্র হওয়ার জন্য রাজপুত্রের আসনে বসার যোগ্য নও।” এই কথাগুলি কর্ণের মনোবল ভেঙে দিয়েছিল। কিন্তু কর্ণ কখনো পিছপা হননি। তিনি কৌরবদের জন্য তার জীবন উৎসর্গ করেছিলেন।
মহাভারতে একটি উক্তি আছে: “উদ্যমেন হি সিধ্যন্তি কর্মাণি।” কর্ণ তার উদ্যমের মাধ্যমে প্রমাণ করেছিলেন যে পরিচয় বা জন্ম নয়, চরিত্রই মানুষের প্রকৃত পরিচয়।
কর্ণ এবং অর্জুনের দ্বন্দ্ব
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অর্জুন এবং কর্ণের দ্বন্দ্ব একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত। কিন্তু যুদ্ধের আগে শ্রীকৃষ্ণ যখন কর্ণকে তার জন্মপরিচয়ের কথা জানান, তখন কর্ণ মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। শ্রীকৃষ্ণ বলেছিলেন, “তুমি পাণ্ডব, তুমি অর্জুনের ভাই।” কর্ণ তখন উত্তর দিয়েছিলেন, “আমার পরিচয় কি আজই বদলে যাবে? আমি সারা জীবন যাদের সঙ্গী করে চলেছি, তাদের ছেড়ে কীভাবে চলে যাব?”
এই উত্তরের মধ্যে কর্ণের যন্ত্রণার গভীরতা স্পষ্ট। তার নিজের জন্মপরিচয় তাকে সারা জীবন এক অদ্ভুত যন্ত্রণা এবং দ্বন্দ্বের মধ্যে আটকে রেখেছিল।
আমাদের জীবনের সাথে কর্ণের মিল
আপনি কি কখনো অনুভব করেছেন যে আপনার সামাজিক পরিচয়ের কারণে আপনাকে অবজ্ঞা করা হয়েছে? সমাজের অবজ্ঞা কখনো কখনো এমন এক মানসিক অত্যাচারের রূপ নেয়, যা আমাদের মনোবল ভেঙে দিতে পারে। কিন্তু কর্ণের জীবন থেকে আমরা শিখি যে, এই অত্যাচারকে অগ্রাহ্য করে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।
কর্ণের শিক্ষা
মহাভারত থেকে আমরা যে শিক্ষা পাই তা হল, সমাজের মতামত নয়, আপনার কাজই আপনার আসল পরিচয়। কর্ণের উদাহরণ আমাদের শেখায়, আপনি যত প্রতিকূল অবস্থায় থাকুন না কেন, নিজের লক্ষ্য থেকে কখনো সরে আসবেন না।
উপসংহার
কর্ণের প্রতি সমাজের অবজ্ঞা নিঃসন্দেহে একধরনের মানসিক অত্যাচার ছিল। কিন্তু এই অত্যাচারের মধ্যেই কর্ণ নিজের প্রতিভার বিকাশ ঘটিয়েছিলেন। তার জীবন আমাদের শেখায় যে সমাজের বিধি-বিধান এবং অবজ্ঞার ঊর্ধ্বে উঠে আমাদের নিজেদের পরিচয় গড়ে তুলতে হবে।