আমরা মহাভারতের গল্প পড়ে এবং শোনার সময় কুন্তীর চরিত্রে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত হই। কুন্তী ছিলেন এমন এক নারী, যিনি তার সন্তানদের জন্য মায়ের মতো আশ্রয় এবং প্রেরণা জুগিয়েছেন, এমনকি দুঃসময়ে তাঁর সাহস এবং আত্মত্যাগ দিয়ে তাদের জীবন পথ দেখিয়েছেন। এই প্রাচীন মহাকাব্যে কুন্তী কেবলমাত্র একজন মা নন; তিনি একজন পথপ্রদর্শক এবং নৈতিকতার আদর্শ।
আজকের যুগে, যদি আমরা কুন্তীর জীবন থেকে কিছু শিক্ষা গ্রহণ করি, তবে তা আমাদের ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক জীবনে গভীর ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারে। আসুন, কুন্তীর জীবনের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক এবং তার সন্তানদের প্রতি তার আচরণের উদাহরণ নিয়ে আলোচনা করি।
মাতৃত্বের প্রথম পরীক্ষা: কর্ণের প্রতি ভালোবাসা এবং ত্যাগ
কুন্তীর প্রথম সন্তান কর্ণ, যাকে তিনি জন্মের পরই ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। এই পরিস্থিতি আমাদের দেখায়, একজন মা কখনও নিজের সন্তানকে ভালোবাসতে ভুলে না। মহাভারতে বলা হয়েছে:
“ধর্ম কি কঠিন, কিন্তু মাতৃত্ব তার চেয়েও কঠিন।”
যদিও কর্ণকে ত্যাগ করার পেছনে সামাজিক ও পারিবারিক কারণ ছিল, তবুও কুন্তী তার প্রতি ভালোবাসা কখনও হারাননি। তিনি কর্ণকে দানবীর হিসেবে গড়ে উঠতে সাহায্য করেছিলেন, এমনকি তাকে সবসময় ন্যায়ের পথে চলার অনুপ্রেরণা দিয়েছেন। এই ঘটনা আমাদের শেখায়, কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়া সত্ত্বেও একজন মা কখনও তার সন্তানের কল্যাণের কথা ভুলতে পারেন না।
পাঁচ পাণ্ডবের প্রতি কুন্তীর নিঃশর্ত ভালোবাসা
কুন্তী তার পাঁচ পুত্রের প্রতি মায়ের ভূমিকা পালন করেছেন নিঃস্বার্থভাবে। তাদের প্রতিটি সিদ্ধান্ত এবং চ্যালেঞ্জে তিনি তাদের পাশে থেকেছেন। উদাহরণস্বরূপ, যখন দ্রৌপদীর বিবাহের সময় তিনি পাঁচ ভাইকে সমানভাবে তার সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে বলেছিলেন, তখন তার উদ্দেশ্য ছিল পরিবারের ঐক্য বজায় রাখা।
তিনি জানতেন, পাণ্ডবরা একত্রে থাকলেই কৌরবদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারবে। এই প্রসঙ্গে, মহাভারতে বলা হয়েছে:
“যেখানে ঐক্য, সেখানেই শক্তি।”
আপনি যদি আপনার জীবনে পরিবারে ঐক্য বজায় রাখতে চান, তবে কুন্তীর মতো মনের দৃঢ়তা ও বুদ্ধিমত্তা প্রয়োজন।
বিপদের সময়ে সাহসিকতার পরিচয়
কুন্তী তার সন্তানদের কখনও বিপদের সামনে একা ছেড়ে দেননি। জুয়ার খেলায় যখন পাণ্ডবরা সবকিছু হারিয়ে বনবাসে যেতে বাধ্য হয়, তখন কুন্তী তাদের পাশে ছিলেন। তিনি বারবার তাদের বলেছিলেন,
“তোমাদের পরিশ্রম এবং ধর্ম অনুসরণই তোমাদের সত্যিকারের সম্পদ।”
তিনি বুঝেছিলেন যে দুঃসময় অস্থায়ী এবং কেবলমাত্র সাহস, আত্মনিয়ন্ত্রণ এবং পরিশ্রমই মানুষকে সাফল্যের দিকে নিয়ে যেতে পারে। আপনি যখন জীবনে কোনো চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হন, কুন্তীর এই শিক্ষা আপনার শক্তি হতে পারে।
দ্রৌপদীর প্রতি মাতৃসুলভ দৃষ্টিভঙ্গি
কুন্তী শুধুমাত্র পাণ্ডবদের মা ছিলেন না, দ্রৌপদীর প্রতিও তার আচরণ ছিল মাতৃসুলভ। তিনি দ্রৌপদীকে সর্বদা সমর্থন করেছিলেন এবং পাণ্ডবদের নৈতিক পথ অনুসরণ করতে বলেছিলেন। দ্রৌপদী যখন অপমানিত হয়েছিলেন, তখন কুন্তী তার সম্মান পুনরুদ্ধারে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন,
“সম্মান হরণ কারও নৈতিকতার পতনের চেয়ে বড় নয়।”
আজকের সমাজে, যেখানে নারীদের সম্মান এবং অধিকার প্রায়ই হুমকির মুখে পড়ে, কুন্তীর এই দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের জন্য খুবই প্রাসঙ্গিক।
কুন্তীর আত্মত্যাগ এবং ন্যায়পরায়ণতা
কুন্তীর সবচেয়ে বড় গুণ ছিল তার আত্মত্যাগ এবং ন্যায়পরায়ণতা। মহাভারতের যুদ্ধে তিনি কর্ণ এবং অর্জুনের সংঘর্ষ এড়ানোর চেষ্টা করেছিলেন। যদিও তিনি জানতেন, কর্ণ তার বড় ছেলে, তবুও ধর্ম এবং পরিবারের বৃহত্তর মঙ্গলের জন্য তিনি কঠিন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন। মহাভারতে এটি বলা হয়েছে:
“ধর্মই সর্বোচ্চ, এবং সত্যই তার ভিত্তি।”
কুন্তীর এই গুণ আমাদের শেখায়, জীবনের যেকোনো পরিস্থিতিতে ন্যায়পরায়ণ থাকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ।
কুন্তীর শিক্ষাকে জীবনে প্রয়োগ
কুন্তীর জীবনের প্রতিটি অধ্যায় আমাদের একটি বার্তা দেয়—ত্যাগ, সাহস, ন্যায়পরায়ণতা, এবং পরিবারে ঐক্যের গুরুত্ব। আপনি যদি আপনার জীবনে এই শিক্ষাগুলি অনুসরণ করেন, তাহলে আপনি আপনার চারপাশের মানুষদের জন্য একজন অনুপ্রেরণা হয়ে উঠবেন।