আমরা অনেক সময় কুরুক্ষেত্র যুদ্ধকে শুধুমাত্র এক বৃহৎ সংঘর্ষের প্রতীক হিসেবেই দেখি। কিন্তু, আপনি কি ভেবে দেখেছেন, এই যুদ্ধ কি আদৌ সন্ত্রাস বা উগ্রবাদের প্রতীক হতে পারে? মহাভারত এমন একটি মহাকাব্য যেখানে ন্যায়, অন্যায়, ধর্ম এবং মানবীয় আবেগের গভীর চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। এর মাধ্যমে আমরা আমাদের জীবনের কঠিন প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে পেতে পারি।
প্রথমেই আপনাকে বলি, কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ শুধুমাত্র এক ভয়াবহ যুদ্ধ নয়, বরং এটি ছিল এক ধর্মযুদ্ধ। এই ধর্মযুদ্ধের পেছনে লুকিয়ে রয়েছে ন্যায় ও অন্যায়ের সংঘাত। মহাভারতের মূল শিক্ষা হলো ধর্ম বা সঠিক পথ অনুসরণ করা। কিন্তু যখন অন্যায় প্রভাব বিস্তার করে, তখন সেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো কি উগ্রবাদ? আসুন, এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে কিছু উদাহরণ দেখি।
ধর্ম ও অধর্মের সংঘাত
কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের প্রধান কারণ ছিল ধর্ম ও অধর্মের দ্বন্দ্ব। দুর্যোধন ও তার ভাইরা পাণ্ডবদের সম্পত্তি ছিনিয়ে নিয়েছিল। যখন দ্রৌপদীকে প্রকাশ্যে অপমান করা হয়, তখন আপনি কি মনে করেন, সেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে না দাঁড়ানো উচিত ছিল? কৃষ্ণ গীতায় বলেন:
“যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত।
অভ্যুৎথানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্।।”
(গীতা, অধ্যায় ৪, শ্লোক ৭)
অর্থাৎ, যখনই ধর্মের অবনতি ঘটে এবং অধর্মের উত্থান হয়, তখনই আমি নিজেকে মর্ত্যে প্রেরণ করি। এই শ্লোক থেকে আমরা বুঝতে পারি, কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ ধর্ম প্রতিষ্ঠার জন্য একটি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ ছিল।
কিন্তু আমরা যদি আধুনিক সময়ের সন্ত্রাস বা উগ্রবাদ নিয়ে ভাবি, তাহলে দেখতে পাব যে সেগুলি প্রায়ই ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগত স্বার্থসিদ্ধির জন্য পরিচালিত হয়। অন্যদিকে, কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ ছিল ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য।
সহিংসতা কি সঠিক উপায়?
আপনার মনে হতে পারে, সহিংসতা কি আদৌ কোনো সমস্যার সমাধান হতে পারে? এই প্রশ্ন আমি নিজেও করেছি। কিন্তু মহাভারত আমাদের শেখায় যে, কখনো কখনো বৃহত্তর কল্যাণের জন্য কঠিন পদক্ষেপ নিতে হয়। উদাহরণস্বরূপ, যখন অর্জুন যুদ্ধক্ষেত্রে যুদ্ধ করতে অস্বীকার করেন, তখন কৃষ্ণ তাকে গীতার মাধ্যমে প্রকৃত দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেন। তিনি বলেন:
“স্বধর্মমপি চাবেক্ষ্য ন বিকম্পিতুমর্হসি।
ধর্ম্যাদ্ধি যুদ্ধাচ্ছ্রেয়ো’nyত্ ক্ষত্রিয়স্য ন বিদ্যতে।।”*
(গীতা, অধ্যায় ২, শ্লোক ৩১)
অর্থাৎ, নিজের ধর্ম পালন থেকে পিছিয়ে আসা একজন ক্ষত্রিয়ের জন্য লজ্জাজনক। এই শ্লোক স্পষ্টভাবে বোঝায় যে কখনো কখনো ধর্ম রক্ষার জন্য যুদ্ধ অপরিহার্য হয়ে পড়ে।
কুরুক্ষেত্রের শিক্ষা ও আমাদের জীবন
এখন প্রশ্ন হলো, আপনি এবং আমি কিভাবে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের শিক্ষা আমাদের জীবনে প্রয়োগ করব? আজকের যুগে আমরা বিভিন্ন রকম সংঘাত ও সমস্যার মুখোমুখি হই। আমাদের পরিবারে, কর্মক্ষেত্রে, এমনকি সমাজেও আমরা অন্যায়ের শিকার হই।
তবে এখানে সন্ত্রাস ও উগ্রবাদের ধারণা থেকে মহাভারতের শিক্ষা আলাদা। মহাভারতের যুদ্ধ আমাদের শেখায় কীভাবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হয়, কিন্তু সেই সঙ্গে আমাদের মানবিকতা এবং ন্যায়বোধকে ধরে রাখতে হয়। উদাহরণস্বরূপ, যদি আপনার সহকর্মী আপনাকে অন্যায়ভাবে দোষারোপ করেন, তাহলে আপনি কি চুপ করে থাকবেন? মহাভারত বলবে, না। কিন্তু, সেই প্রতিবাদ হতে হবে ন্যায়সংগত এবং অহিংস পদ্ধতিতে।
কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ: উগ্রতা নাকি আত্ম-উন্নয়নের পথ?
কুরুক্ষেত্র যুদ্ধকে উগ্রবাদের প্রতীক বলা ভুল হবে। এটি বরং আত্ম-উন্নয়ন এবং ন্যায়বোধের প্রতীক। মহাভারতের শিক্ষা অনুযায়ী, আপনাকে প্রথমে নিজেকে জিজ্ঞাসা করতে হবে: আপনার উদ্দেশ্য কি? যদি আপনার লক্ষ্য সঠিক হয়, তবে তার জন্য লড়াই করাটা আপনার কর্তব্য।
অর্জুন যখন যুদ্ধক্ষেত্রে দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন, তখন কৃষ্ণ তাকে বলেছিলেন:
“কার্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন।
মা কর্মফলহেতুর্ভূর্মা তে সঙ্গো’স্ত্বকর্মণি।।”*
(গীতা, অধ্যায় ২, শ্লোক ৪৭)
অর্থাৎ, তোমার কাজ করা উচিত, কিন্তু ফলের প্রতি আসক্ত হওয়া উচিত নয়।
আপনার জীবনে যদি কোনো সমস্যা থাকে, আপনি কি কেবল ফল নিয়ে ভাববেন, নাকি সঠিক পথে থাকার চেষ্টা করবেন? এই শিক্ষাই মহাভারত আমাদের দিতে চায়।
এক গভীর প্রশ্ন
মহাভারত আমাদের জীবন সম্পর্কে গভীর শিক্ষা দেয়। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ শুধুমাত্র এক ঐতিহাসিক ঘটনা নয়, বরং এটি আমাদের জীবনের বিভিন্ন দিকের প্রতীক। তবে সন্ত্রাস বা উগ্রবাদ যেখানে নিজস্ব স্বার্থের জন্য ক্ষতি করে, কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ আমাদের শেখায় কিভাবে বৃহত্তর কল্যাণের জন্য নিজেদের ত্যাগ করতে হয়।
তাহলে, এখন প্রশ্ন হচ্ছে—আপনি কি আপনার জীবনের কুরুক্ষেত্র যুদ্ধকে সঠিকভাবে পরিচালনা করতে প্রস্তুত? মহাভারতের আদর্শে আপনি কি ন্যায় প্রতিষ্ঠার পথে এগিয়ে যেতে পারবেন?
ভাবুন, সিদ্ধান্ত নিন, এবং মহাভারতের আলোকে আপনার জীবনকে গড়ে তুলুন।