জীবনের যে কোনো সমস্যার সমাধানে শ্রীকৃষ্ণের গীতা থেকে উপদেশ নেওয়া যেতে পারে। আমি যখন গীতার বিভিন্ন অধ্যায় পড়ি, তখন বুঝতে পারি, এর গভীর জ্ঞান শুধু আধ্যাত্মিকতা বা ধর্মের জন্য নয়, বরং এটি জীবনের জটিল সমস্যা মোকাবিলার জন্যও কার্যকর। আপনি কি কখনো ভেবেছেন, উগ্রবাদ বা চরমপন্থার মতো সামাজিক সমস্যাগুলোর মূলে কী রয়েছে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গীতা আমাদের যে শিক্ষা দেয়, তা বিস্ময়কর।
গীতার প্রাসঙ্গিকতা
গীতা আমাদের শেখায়, নিজের কর্তব্য পালন করতে এবং মনোভাবকে স্থিতিশীল রাখতে। “কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন।” (২:৪৭) শ্রীকৃষ্ণ এখানে স্পষ্ট করে বলেছেন যে কাজ করাই আমাদের প্রধান দায়িত্ব; কাজের ফলাফল নিয়ে চিন্তা করাটা আমাদের দায়িত্ব নয়। উগ্রবাদ জন্ম নেয় তখন, যখন মানুষ নিজের দৃষ্টিভঙ্গি বা উদ্দেশ্যকে সর্বোচ্চ ভাবতে শুরু করে এবং অন্যের চিন্তাধারাকে অসম্মান করে। আপনি কি মনে করেন, যদি আমরা গীতার এই উপদেশ অনুসরণ করে নিজ নিজ কর্তব্যে মনোনিবেশ করি, তবে উগ্রতার মূলে থাকা অহংবোধ ও সংকীর্ণতাকে কমানো সম্ভব?
অর্জুনের সংশয় ও তার সমাধান
গীতার মূল ঘটনা মনে আছে তো? অর্জুন যখন যুদ্ধক্ষেত্রে নিজের আত্মীয়-স্বজনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে অসহায় বোধ করছিল, তখন শ্রীকৃষ্ণ তাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন। “যো যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে পলায়ন করে, সে কখনো শান্তি পায় না।” (গীতা, ২:৩৭) আপনি যদি নিজের অবস্থান থেকে এই পরিস্থিতি বিবেচনা করেন, তাহলে বুঝবেন যে এই শিক্ষাটি কেবল ব্যক্তিগত জীবনের জন্য নয়, বরং উগ্রবাদ মোকাবিলায়ও কার্যকর। আমরা যদি আমাদের দায়িত্ব পালন থেকে পিছিয়ে না যাই, তবে সমাজে ভারসাম্য রক্ষা করা সম্ভব।
অহিংসা ও মানসিক স্থিরতা
গীতার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো অহিংসার উপর জোর। শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, “অহিংসা পরম ধর্ম।” এটি শুধুমাত্র শারীরিকভাবে নয়, মানসিকভাবেও প্রাসঙ্গিক। উগ্রবাদ ছড়ায় তখন, যখন মানুষ অন্যদের ক্ষতি করার মানসিকতা পোষণ করে। আপনি কি জানেন, অহিংসা চর্চা করলে কেবল বাহ্যিক সংঘর্ষ নয়, অন্তর্দ্বন্দ্বও কমে যায়? আপনি নিজেও আপনার জীবনে অহিংসা অনুসরণ করে এর ফলাফল অনুভব করতে পারেন।
মোহ ও মায়ার বন্ধন ছাড়া
গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বারবার বলেছেন, “মোহই আমাদের সবচেয়ে বড় শত্রু।” (গীতা, ২:৫৬) মোহ বা মায়ার বন্ধন আমাদের দৃষ্টি বিভ্রান্ত করে এবং সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে বাধা দেয়। আপনি যদি ভেবে দেখেন, উগ্রবাদের পিছনে সবচেয়ে বড় চালিকাশক্তি হলো অন্ধ বিশ্বাস এবং ভ্রান্ত ধারণা। শ্রীকৃষ্ণের এই শিক্ষা আমাদের শেখায়, কেবল সত্য ও যুক্তির উপর নির্ভর করতে। যদি আপনি সত্যের অনুসন্ধান করেন, তবে উগ্র চিন্তাধারাকে দূর করা সম্ভব।
নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার শিক্ষা
শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, “যে ব্যক্তি নিজের মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, সে-ই প্রকৃত বিজয়ী।” (গীতা, ৬:৬) উগ্রবাদী মানসিকতা প্রায়শই নিজেদের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। শ্রীকৃষ্ণের এই বার্তা যদি আমরা অনুসরণ করি, তাহলে আমরা নিজেদের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি এবং কুসংস্কার বা অতিরিক্ত আবেগপ্রবণতা থেকে মুক্তি পেতে পারি।
সাম্য ও সহনশীলতার বার্তা
গীতার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হলো সাম্য এবং সহনশীলতা। শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, “সকল জীব এক এবং অভিন্ন।” (গীতা, ৫:১৮) যদি আমরা সমাজে এই চেতনা প্রসারিত করতে পারি, তাহলে উগ্রবাদী মতবাদগুলো তাদের ভিত্তি হারাবে। কারণ, তারা বিভাজনের মাধ্যমে শক্তি পায়।
গীতার উপদেশ বাস্তব জীবনে প্রয়োগ
আপনার জীবনে এই শিক্ষাগুলো কতটা কার্যকর হতে পারে, তা কেবল আপনার অভিজ্ঞতাই বলে দেবে। আপনি যদি শ্রীকৃষ্ণের মতো নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে জীবনকে দেখেন, তাহলে আপনার সিদ্ধান্তগুলো আরও শান্তিপূর্ণ এবং যুক্তিনির্ভর হবে। আর তখন উগ্রবাদী চিন্তাধারা আপনার চারপাশে প্রভাব বিস্তার করতে পারবে না।
শেষ কথা
গীতার প্রতিটি শ্লোকই জীবনের জন্য একেকটি দিশা। আপনি যদি মন দিয়ে এর পাঠ নেন এবং উপলব্ধি করেন, তাহলে সমাজের কোনো অপশক্তি আপনার মন ও মনোভাবকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। “আপনি কি নিজের জীবনকে এমনভাবে গড়ে তুলতে চান, যেখানে শ্রীকৃষ্ণের গীতার মতো গভীর জ্ঞান প্রতিফলিত হয়?” এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজুন আপনার জীবনের প্রতিটি দিনে।