আপনারা হয়তো অনেকেই জানেন, মহাভারত আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে শিক্ষার এক অসাধারণ ভান্ডার। এর ভেতরেও কৃষ্ণ এবং অর্জুনের বন্ধুত্ব আমাদের শেখায় আত্মত্যাগ, বিশ্বাস এবং সত্যিকার বন্ধুত্বের মর্ম। আমি যখন মহাভারতের গল্প পড়ি বা শুনি, তখন এই দুজনের সম্পর্ক আমাকে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত করে। আসুন দেখি কীভাবে তাদের বন্ধুত্ব মহাভারতের কেন্দ্রবিন্দু এবং আমাদের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে।
এক বন্ধুত্ব যা সবকিছুর ঊর্ধ্বে
কৃষ্ণ এবং অর্জুনের বন্ধুত্ব শুধু সাধারণ বন্ধুত্ব নয়; এটি ছিল আত্মিক এবং কৌশলগত। এই বন্ধুত্বে শুধু বিশ্বাস নয়, ছিল একে অপরের প্রতি নিঃশর্ত সমর্থন। গীতায় কৃষ্ণ বলেছেন:
“যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত।” (ভগবদ্গীতা, ৪.৭)
এই উক্তির মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারি, কৃষ্ণ সবসময় সত্য এবং ধর্মের পথে অর্জুনকে নিয়ে যেতে চেয়েছেন। বন্ধুত্বের মূলে ছিল ধর্মের রক্ষা এবং জীবনের সঠিক পথ বেছে নেওয়া।
কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ
আপনি যদি কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের কথা ভাবেন, তাহলে দেখবেন, এই যুদ্ধ কৃষ্ণ এবং অর্জুনের বন্ধুত্বের সবচেয়ে বড় উদাহরণ। যুদ্ধের শুরুতেই অর্জুন দোটানায় পড়ে যান এবং বলেন:
“ন যোত্স্য ইতি গোবিন্দ।” (ভগবদ্গীতা, ১.৪৭)
অর্জুন যুদ্ধ করতে চাননি, কারণ তিনি বুঝতে পারছিলেন না কীভাবে নিজের পরিবার ও আত্মীয়দের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবেন। সেই মুহূর্তে কৃষ্ণ তাকে সঠিক পথ দেখান এবং গীতার মাধ্যমে জীবনের গভীরতম সত্য তুলে ধরেন।
সুভদ্রার বিবাহ
আপনি কি জানেন, অর্জুনের জীবনে সুভদ্রার প্রবেশও কৃষ্ণের কৌশলের ফল? কৃষ্ণ নিজেই অর্জুনকে পরামর্শ দেন কিভাবে সুভদ্রাকে ভালোবাসা এবং বিয়ে করতে হবে। এই ঘটনা আমাদের শেখায়, সত্যিকারের বন্ধু সবসময় আপনার ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক জীবনে পাশে থাকবেন।
কৃষ্ণের সারথির ভূমিকা
যখন কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে কৃষ্ণ অর্জুনের সারথি হন, তখন তিনি দেখিয়েছিলেন বন্ধুত্বের প্রকৃত মানে। সারথি হওয়া শুধু রথ চালানোর কাজ নয়, এটি ছিল নেতৃত্ব দেওয়া, সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করা এবং সব পরিস্থিতিতে পাশে থাকা। কৃষ্ণ অর্জুনকে বলেছিলেন:
“ক্লৈব্যং মা স্ম গমঃ পার্থ।” (ভগবদ্গীতা, ২.৩)
অর্থাৎ, তোমার দুর্বলতা পরিহার করো এবং নিজের ধর্ম পালন করো।
উদাহরণ ৪: ভিষ্মের প্রতিজ্ঞা
অর্জুন যখন ভিষ্মকে পরাজিত করতে অক্ষম হন, তখন কৃষ্ণ নিজেই যুদ্ধক্ষেত্রে অস্ত্র তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। যদিও কৃষ্ণ শপথ করেছিলেন যে তিনি অস্ত্র ধরবেন না, কিন্তু বন্ধুর জন্য শপথ ভঙ্গ করতেও প্রস্তুত ছিলেন। এটি আমাদের শেখায়, বন্ধুত্বে আত্মত্যাগের কোনো বিকল্প নেই।
মহাভারতের পাঠ আমাদের জীবনে
আপনার এবং আমার মতো সাধারণ মানুষের জীবনে এই বন্ধুত্বের শিক্ষা কীভাবে প্রাসঙ্গিক? প্রথমত, এটি আমাদের শেখায় যে বন্ধুত্বে বিশ্বাস এবং সমর্থন অপরিহার্য। দ্বিতীয়ত, জীবনের প্রতিটি বড় সিদ্ধান্তে একজন সত্যিকারের বন্ধু আপনার পাশে থাকবেন।
আমার মনে আছে, একবার আমি কঠিন পরিস্থিতিতে পড়েছিলাম। তখন আমার এক বন্ধু আমাকে সঠিক পরামর্শ দিয়েছিল এবং পাশে দাঁড়িয়েছিল। সেই মুহূর্তে আমি বুঝেছিলাম, বন্ধুত্ব মানে শুধু আনন্দের মুহূর্ত ভাগাভাগি করা নয়, এটি দুঃসময়ে একে অপরের হাত শক্ত করে ধরা।
উপসংহার
অতএব, কৃষ্ণ এবং অর্জুনের বন্ধুত্ব আমাদের দেখায় জীবনের সঠিক পথ কীভাবে খুঁজে নিতে হয়। আপনি যদি মহাভারতের এই শিক্ষাগুলি জীবনে প্রয়োগ করেন, তাহলে আপনার জীবনও সমৃদ্ধ হবে।
তাহলে, আপনি কি নিজের জীবনে এমন একজন বন্ধুকে পেয়েছেন, যিনি আপনার কৃষ্ণ বা অর্জুন? যদি না পান, তাহলে আপনি কীভাবে এমন বন্ধুত্ব গড়ে তুলতে পারেন? ভাবুন এবং মহাভারতের শিক্ষা দিয়ে নিজের জীবন আলোকিত করুন।