আপনার জীবনে এমন পরিস্থিতি কি কখনো এসেছে, যখন আপনি দিশেহারা বোধ করেছেন? মনে হয়েছে, সবকিছু ভুল হচ্ছে, আর আপনার মধ্যে কোনো শক্তি অবশিষ্ট নেই? মহাভারতের কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের শুরুর মুহূর্তে অর্জুনের ঠিক এমনই অবস্থা হয়েছিল। তার দিশেহারা মনোভাব আর মানসিক শক্তি পুনরুদ্ধারে যে ব্যক্তি তাকে সাহায্য করেছিলেন, তিনি হলেন ভগবান কৃষ্ণ। আজ আমি আপনাকে এই গল্পের গভীরে নিয়ে যাব, এবং দেখাবো কীভাবে কৃষ্ণের শিক্ষা আমাদের জীবনেও পথপ্রদর্শক হতে পারে।
অর্জুনের ভগ্নাবস্থা
কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগমুহূর্তে অর্জুনের অবস্থার কথা ভাবুন। তিনি একজন দক্ষ যোদ্ধা, কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে পা রাখার সময়ই তার আত্মবিশ্বাস ভেঙে পড়ে। সামনে তিনি দেখতে পান তার নিজের পরিবার, আত্মীয়স্বজন, শিক্ষক, এবং প্রিয়জনদের। তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র তোলার চিন্তাই তাকে ভীত, হতাশ, এবং অসহায় করে তোলে। তিনি কৃষ্ণের প্রতি আর্তি জানিয়ে বলেন:
“ধর্মসংমূঢ়চেতাঃ স্মৃতিভ্রংশম্ প্রাপ্য চ।”
(গীতা, ২.৭)
অর্জুন স্বীকার করেন, তার মন সম্পূর্ণ বিভ্রান্ত। তিনি আর জানেন না কোনটা ঠিক, কোনটা ভুল। এই পরিস্থিতিতে তিনি কৃষ্ণকে নিজের সারথি হিসেবে নয়, বরং নিজের গুরুর মতো পথপ্রদর্শক হিসেবে দেখতে চান।
কৃষ্ণের ভূমিকা: একজন বন্ধুর চেয়েও বেশি
কৃষ্ণ এখানে কেবল অর্জুনের বন্ধু নন, তিনি অর্জুনের জীবনের গুরু, তার মেন্টর। কৃষ্ণের কথাগুলো অর্জুনের মনে যে প্রভাব ফেলে, তা চিরন্তন। কৃষ্ণ অর্জুনকে যে চারটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা দেন, তা আমাদের জীবনেও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক।
১. ধর্মের পথে থাকার শিক্ষা
কৃষ্ণ অর্জুনকে মনে করিয়ে দেন, তার কাজ হলো ধর্মের পথে থাকা। তিনি বলেন:
“স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়ঃ পরধর্মো ভয়াবহঃ।”
(গীতা, ৩.৩৫)
অর্থাৎ, নিজের ধর্ম মেনে চলা শ্রেয়। অন্যের পথে গেলে ভয়াবহ পরিণতি হতে পারে। কৃষ্ণ বুঝিয়ে দেন, অর্জুনের কর্তব্য হলো কৌরবদের বিরুদ্ধে লড়াই করা, কারণ এটি তার দায়িত্ব এবং ধর্ম। আমাদের জীবনে অনেক সময় এমন পরিস্থিতি আসে, যখন আমরা আমাদের কর্তব্য নিয়ে সন্দেহ করি। এই অবস্থায় কৃষ্ণের এই শিক্ষা আমাদের শক্তি দিতে পারে।
২. আত্মবিশ্বাস পুনরুদ্ধার
কৃষ্ণ অর্জুনকে বারবার মনে করিয়ে দেন যে, সে একজন অসাধারণ যোদ্ধা। তিনি বলেন:
“তস্মাদ্যুদ্ধায় যুজ্যস্ব জিতাশ্রুরঃ ভবঃ।”
(গীতা, ১১.৩৪)
অর্থাৎ, যুদ্ধ কর এবং জয়লাভ কর। অর্জুনের শক্তি ও দক্ষতায় ভগবান কৃষ্ণ অটুট বিশ্বাস রাখেন। তিনি অর্জুনকে আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করেন, যা আমাদের নিজেদের জীবনে কঠিন পরিস্থিতিতে প্রয়োজন।
৩. মনোযোগ এবং যোগ
কৃষ্ণ অর্জুনকে শিক্ষা দেন মনোযোগ ধরে রাখার। তিনি বলেন:
“যোগঃ কর্মসু কৌশলম্।”
(গীতা, ২.৫০)
অর্থাৎ, যোগ হচ্ছে কাজের নিপুণতা। মনোযোগ দিয়ে এবং সঠিকভাবে কাজ করলে সাফল্য আসবেই। আমাদেরও নিজের লক্ষ্যে মনোনিবেশ করতে হবে, আর প্রতিকূলতা মোকাবিলার জন্য মানসিক স্থিরতা বজায় রাখতে হবে।
৪. ফলাফল ছাড়াই কাজ করার শিক্ষা
কৃষ্ণ বারবার বলেন:
“কর্মণ্যে বেধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন।”
(গীতা, ২.৪৭)
আপনার কাজের প্রতি অধিকার আছে, কিন্তু ফলাফলের প্রতি নয়। অর্জুনের দুশ্চিন্তা ছিল ফলাফল নিয়ে – কে জিতবে, কে মরবে। কৃষ্ণ তাকে শেখান, কাজ করার সময় ফলাফলের চিন্তা দূরে সরিয়ে রাখতে।
কৃষ্ণের শিক্ষা আমাদের জীবনে প্রাসঙ্গিক
এবার ভাবুন, এই শিক্ষাগুলো কীভাবে আপনার জীবনে কাজে লাগতে পারে।
১. কর্তব্যপালনের গুরুত্ব
যখন আপনি আপনার জীবন নিয়ে বিভ্রান্ত বোধ করেন, তখন আপনাকে নিজের দায়িত্বের কথা ভাবতে হবে। কর্মক্ষেত্র হোক বা ব্যক্তিগত জীবন, কৃষ্ণের মতো গুরুর কথা মনে রাখতে হবে – যা সঠিক, সেটাই করুন।
২. আত্মবিশ্বাস ধরে রাখা
আপনার জীবনের প্রতিকূল সময়ে কৃষ্ণের মতো কোনো ব্যক্তি যদি আপনাকে মনে করিয়ে দেন আপনার ক্ষমতার কথা, তাহলে আপনি আবার দৃঢ় হতে পারবেন। আপনার নিজের ভেতরের ‘কৃষ্ণ’কে খুঁজে বের করুন।
৩. মনোযোগ ও স্থিরতা বজায় রাখা
ধ্যান বা যোগাভ্যাসের মাধ্যমে মন স্থির রাখতে পারেন। কৃষ্ণের শিক্ষা শুধুমাত্র অর্জুনের জন্য নয়, আমাদের জন্যও।
৪. ফলাফলের চিন্তা ছেড়ে দেওয়া
আপনার কাজ করুন, কিন্তু ফলাফলের চিন্তা আপনাকে নিরুৎসাহিত করতে দেবেন না। এটি মানসিক শান্তি এনে দেয়।
শেষ কথা
কৃষ্ণের শিক্ষা শুধু অর্জুনের জন্য নয়, আমাদের সবার জন্য। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ আমাদের জীবনের সংকটের প্রতীক। যখনই মনে হবে সবকিছু অন্ধকার, তখন কৃষ্ণের কথাগুলো মনে করুন। আপনার নিজের জীবনের কৃষ্ণকে খুঁজে বার করুন, যিনি আপনাকে পথ দেখাবেন।