আমরা মহাভারতের কথা বললে, এক অনন্ত জ্ঞান ও শিক্ষা ভাণ্ডারের সামনে দাঁড়াই। এই মহাগ্রন্থে থাকা কাহিনিগুলো আমাদের জীবনের প্রতিটি দিককে নতুন করে দেখতে শেখায়। কৌরব এবং পাণ্ডবদের মধ্যে বৈরিতার গল্প, বিশেষ করে, আমাদের জন্য এক মূল্যবান পাঠ। কেন এই দুই পরিবারের মধ্যে এত গভীর বৈরিতা সৃষ্টি হলো? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আপনাকে আমি মহাভারতের গভীরে নিয়ে যেতে চাই।
বৈরিতার শিকড়: উত্তরাধিকারের লড়াই
প্রথমত, কৌরব এবং পাণ্ডবদের মধ্যে বৈরিতার মূল কারণ ছিল হস্তিনাপুরের সিংহাসনের উত্তরাধিকারের লড়াই। ভীষ্ম পিতামহ যখন প্রতিজ্ঞা করলেন যে, তিনি কখনোই রাজা হবেন না এবং রাজগুরু হিসেবে কাজ করবেন, তখন সিংহাসন দাবিদার হয়ে পড়ে ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডুর মধ্যে। কিন্তু ধৃতরাষ্ট্র ছিলেন অন্ধ। এই অন্ধত্ব তাকে রাজা হওয়ার যোগ্যতা থেকে বঞ্চিত করেছিল। পাণ্ডু রাজা হন এবং তার মৃত্যুর পর তার সন্তানদের জন্য উত্তরাধিকার স্বাভাবিক মনে করা হয়।
কিন্তু ধৃতরাষ্ট্রের সন্তান দুর্যোধন এই সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেননি। তিনি বরাবরই ভাবতেন, “আমি রাজা হওয়ার যোগ্য। পাণ্ডবরা কেন সিংহাসনের দাবিদার হবে?” দুর্যোধনের এই ইর্ষা ও উচ্চাকাঙ্ক্ষাই কৌরব-পাণ্ডব বৈরিতার প্রথম সূচনা করে। “লোভোদ্ধতি বিনাশায়” – এই শ্লোকটি মহাভারতে একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা দেয়। লোভ ও উচ্চাকাঙ্ক্ষার পরিণতি সবসময় ধ্বংস ডেকে আনে।
দুর্যোধনের ঈর্ষা ও ষড়যন্ত্র
দ্বিতীয়ত, দুর্যোধনের ঈর্ষা ছিল এই বৈরিতার প্রধান কারণ। যখন পাণ্ডবরা ইন্দ্রপ্রস্থে তাদের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করে, তখন দুর্যোধনের ঈর্ষা চরমে পৌঁছায়। মহাভারতে দুর্যোধনের এক উক্তি আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখায় তার মানসিকতা: “যেখানে পাণ্ডবরা সুখে থাকে, সেখানে আমার জন্য শান্তি নেই।”
দুর্যোধনের ষড়যন্ত্রগুলো পাণ্ডবদের জন্য অজস্র কষ্টের কারণ হয়েছিল। যেমন, লাক্ষাগৃহের ঘটনা যেখানে পাণ্ডবদের জীবন্ত পুড়িয়ে মারার চেষ্টা করা হয়েছিল। আবার দ্রৌপদীর চীরহরণের ঘটনা দুর্যোধনের প্রকৃত স্বরূপ তুলে ধরে। এই ঘটনা শুধু কৌরবদের পাপ বৃদ্ধি করেনি, বরং পাণ্ডবদের হৃদয়ে প্রতিশোধের আগুন জ্বালিয়ে দেয়।
দ্রৌপদীর অপমান: বৈরিতার চূড়ান্ত কারণ
দ্রৌপদীর অপমান ছিল কৌরব-পাণ্ডব বৈরিতার চূড়ান্ত একটি কারণ। পাশা খেলায় দুর্যোধন এবং শকুনির কৌশলে পাণ্ডবরা সবকিছু হারায় – রাজ্য, সম্পদ এবং এমনকি দ্রৌপদীকেও। যখন দ্রৌপদীকে দুর্যোধনের আদেশে সভার মধ্যে টেনে আনা হয় এবং দুঃশাসন তার বস্ত্রহরণের চেষ্টা করে, তখন কৌরবরা তাদের নৈতিকতার সব সীমা লঙ্ঘন করে।
এই মুহূর্তটি শুধু পাণ্ডবদের জন্য নয়, সারা সভার জন্য এক কলঙ্কজনক অধ্যায় হয়ে রয়ে যায়। দ্রৌপদীর আর্তি তখন ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে আহ্বান করে: “হে জনার্দন, আমাকে রক্ষা করো।” শ্রীকৃষ্ণ দ্রৌপদীকে রক্ষা করেন, কিন্তু এই অপমান পাণ্ডবদের হৃদয়ে প্রতিশোধের বীজ বপন করে।
কৌরব ও পাণ্ডবদের চরিত্রের পার্থক্য
কৌরব এবং পাণ্ডবদের মধ্যে মূল পার্থক্য ছিল তাদের চরিত্রে। যুধিষ্ঠির ছিলেন ধর্মের প্রতীক, ভীম শক্তির প্রতীক, অর্জুন ছিলেন সাহস ও ন্যায়বিচারের প্রতীক। অন্যদিকে, দুর্যোধন ও তার ভাইদের মধ্যে অহংকার, ঈর্ষা এবং লোভ প্রকটভাবে বিদ্যমান ছিল। মহাভারতে বলা হয়েছে, “ধর্মো রক্ষতি রক্ষিতঃ” অর্থাৎ, যারা ধর্মকে রক্ষা করে, ধর্ম তাদের রক্ষা করে। পাণ্ডবরা সবসময় ধর্ম মেনে চলতেন, আর কৌরবরা নিজেদের স্বার্থের জন্য ধর্ম ভঙ্গ করত।
মহাভারতের শিক্ষা: আমাদের জীবনের প্রাসঙ্গিকতা
আপনার এবং আমার জীবনে এই কাহিনিগুলো কিভাবে প্রাসঙ্গিক? মহাভারতের প্রতিটি ঘটনা আমাদের শেখায় যে, ঈর্ষা, লোভ, এবং অহংকার আমাদের জীবনের শান্তি নষ্ট করে। যদি আমরা কৌরবদের মতো আচরণ করি, তাহলে আমাদের জীবনেও সংঘাত এবং পরাজয় আসবে। পাণ্ডবদের ধর্মনিষ্ঠা আমাদের দেখায়, কিভাবে নৈতিকতার পথে থেকে জীবনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা যায়।
আমি আপনাকে এই প্রশ্ন করতে চাই: আপনার জীবনে কি দুর্যোধনের মতো ঈর্ষা আছে? যদি থাকে, তাহলে আপনি তা কীভাবে পরিত্যাগ করতে পারেন? আপনার কি যুধিষ্ঠিরের মতো ধৈর্য এবং অর্জুনের মতো সাহস আছে? যদি না থাকে, তাহলে কিভাবে তা অর্জন করবেন? মহাভারতের এই প্রশ্নগুলো আমাদের জীবনের পথ দেখায়।
শেষ কথা
মহাভারতের কৌরব এবং পাণ্ডবদের মধ্যে বৈরিতার কাহিনি আমাদের শিখিয়েছে যে, ন্যায়, ধর্ম, এবং সত্যের পথেই শেষ পর্যন্ত জয় হয়। “যুদ্ধ আমাদের শিক্ষা দেয়, কিন্তু শান্তি আমাদের উন্নতি করে।” তাই, আপনি কি আজ থেকেই আপনার জীবনে ধর্ম এবং ন্যায়ের পথে হাঁটবেন? নাকি কৌরবদের মতো ভুল করবেন? এই সিদ্ধান্ত আপনারই।