গন্ধারী—একটি নাম যা মাতৃত্ব, ত্যাগ এবং ধর্মের প্রতীক। মহাভারতে, গন্ধারীর ভূমিকা শুধু একজন স্ত্রী বা রানী হিসেবে নয়; একজন মা হিসেবে তাঁর জীবন ও নীতি আমাদের জন্য এক অসাধারণ উদাহরণ। গন্ধারীর জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ে তাঁর মাতৃত্বের গভীর তাৎপর্য রয়েছে। আসুন, আমরা এই চরিত্রের প্রতি গভীরভাবে নজর দিই।
তাঁর মাতৃত্বের সূচনা: ত্যাগের প্রথম ধাপ
গন্ধারী যখন জানতে পারলেন যে তাঁর স্বামী ধৃতরাষ্ট্র জন্মান্ধ, তিনি তাৎক্ষণিকভাবে নিজের চোখে কাপড় বেঁধে জীবন কাটানোর প্রতিজ্ঞা করলেন। এই কাজের মাধ্যমে তিনি দেখালেন, একটি মা বা স্ত্রীর ভূমিকা কেবল সহানুভূতিতে সীমাবদ্ধ নয়, বরং তা পরিপূর্ণ সমর্থন ও সহবাসের প্রতীক। আপনি কি কখনো ভেবে দেখেছেন, একজন মা তাঁর সন্তানের জন্য কত ত্যাগ স্বীকার করেন? গন্ধারী তাঁর জীবন দিয়ে এই শিক্ষা দেন।
মহাভারতে বলা হয়েছে:
“ধর্মের প্রতি অটল থাকা সত্যিকারের শক্তি।”
গন্ধারীর এই আচরণ আমাদের শেখায়, জীবনের কঠিন পরিস্থিতিতেও ধর্মপথে চলতে হবে।
১০০ পুত্রের মা: অভূতপূর্ব এক অভিজ্ঞতা
গন্ধারী ১০০ পুত্রের মা। তবে, তাঁদের জন্মের গল্পটি যেন কাহিনির বাইরে এক অন্যরকম দৃষ্টান্ত। একবার, মহর্ষি বেদব্যাসের আশীর্বাদে গন্ধারী একসঙ্গে ১০০ সন্তানের জন্ম দেন। কিন্তু প্রতিটি সন্তানের ভবিষ্যৎ ছিল এক করুণ অধ্যায়। গন্ধারী কি জানতেন যে তাঁর পুত্ররা একদিন কৌরব-পাণ্ডবদের মহাযুদ্ধের কেন্দ্রে থাকবে? এই মা তখনও ছিলেন ধৈর্যশীল ও দায়িত্বশীল।
উদাহরণ হিসেবে দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের ঘটনা স্মরণ করা যায়। গন্ধারী সেখানেও নিজেকে প্রকাশ করেছিলেন এক প্রকৃত মায়ের মতো। তিনি ধৃতরাষ্ট্রকে সতর্ক করেছিলেন,
“অধর্মের পথ অবলম্বন করলে পুরো বংশ ধ্বংস হয়ে যাবে।”
যুদ্ধের আগে: গন্ধারীর সতর্কতা ও উপদেশ
যুদ্ধের আগে গন্ধারী তাঁর সন্তানদের বারণ করেছিলেন। তিনি দুর্যোধনকে বারবার বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু দুর্যোধন অহংকারে অন্ধ হয়ে ছিল। একজন মা যেমন তাঁর সন্তানের মঙ্গল চায়, গন্ধারীও তাই করেছিলেন।
“ধর্মই শক্তি, এবং অধর্ম সবসময় পরাজিত হয়।”—এ কথাটি তিনি বারবার বলেছিলেন।
আপনি যদি মহাভারতের গল্প মন দিয়ে পড়েন, দেখবেন গন্ধারীর এই শিক্ষা আমাদের জীবনের জন্য কীভাবে প্রাসঙ্গিক। আজও, যদি আমরা আমাদের সন্তানদের সঠিক পথে চালনা করি, সমাজে শান্তি ফিরে আসতে পারে।
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ এবং গন্ধারীর পুত্রশোক
যুদ্ধের পর গন্ধারীর পুত্ররা সবাই মারা গেল। একজন মা হিসেবে এটা তাঁর জন্য ছিল সবচেয়ে বড় শোক। তবু, তিনি তাঁর শোককে নিজের দুর্বলতা হতে দেননি। তিনি শ্রীকৃষ্ণের কাছে অভিযোগ করেছিলেন, কিন্তু সেখানেও তাঁর ধর্মচেতনাই প্রকাশ পায়। তিনি শ্রীকৃষ্ণকে বলেন:
“তুমি যদি চাও, তবে এই যুদ্ধ আটকাতে পারতে। তবে ধর্মের পথেই সবকিছু ঘটেছে।”
একজন মা হিসেবে, গন্ধারীর এই বক্তব্য আমাদের মনে করিয়ে দেয়—জীবনে অনেক কিছুই আমাদের হাতের বাইরে থাকে। তবুও, ধর্ম ও নৈতিকতায় অবিচল থাকা আমাদের দায়িত্ব।
গন্ধারীর শিক্ষা আমাদের জীবনে কীভাবে প্রাসঙ্গিক?
গন্ধারীর চরিত্র আমাদের শেখায়—মাতৃত্ব কেবল সন্তান জন্ম দেওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি এমন এক অধ্যবসায়, যা পরিবার এবং সমাজের কল্যাণে নিবেদিত। আজকের দিনে, যখন সম্পর্ক এবং নৈতিকতা বিপন্ন, গন্ধারীর মতো মায়ের চরিত্র আমাদের জন্য এক আলোকবর্তিকা হতে পারে।
শেষে আপনাকে একটি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিতে চাই:
আপনার জীবনে, আপনি কি গন্ধারীর মতো ধৈর্য এবং নীতির পথে থাকতে পারবেন?
মহাভারত পড়ুন এবং নিজেকে এই প্রশ্নের উত্তর দিন।