গীতায় কাজ এবং ফলাফলের মধ্যে সম্পর্কের জ্ঞান কীভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে?

আপনি কি কখনও ভেবেছেন, আমরা কেন কাজ করি? আমাদের কাজের ফলাফলই কি আমাদের আনন্দ, দুঃখ, বা জীবনকে সাফল্যের দিকে নিয়ে যায়? এই প্রশ্নের উত্তরে মহাভারতের গীতা আমাদের দারুণ এক শিক্ষার পথ দেখায়। গীতার এই শিক্ষাগুলি জীবনের গভীর সত্যকে প্রকাশ করে। আমি আজ আপনাকে বোঝাতে চাই কীভাবে গীতা আমাদের কাজ এবং ফলাফলের মধ্যে সম্পর্কের গভীরতা শেখায়।

কর্মের গুরুত্ব এবং ফলাফলের প্রতি আসক্তি ত্যাগ

গীতার ২.৪৭ শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলছেন:
“কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন।
মা কর্মফলহেতুর্ভূর্মা তে সঙ্গোস্ত্বকর্মণি।”
অর্থাৎ, আপনার কাজ করার অধিকার আছে, কিন্তু তার ফলের প্রতি আপনার অধিকার নেই। আপনি ফলাফলের জন্য কাজ করবেন না এবং কর্ম না করার জন্যও আপনার প্রবৃত্তি থাকা উচিত নয়।

এই শিক্ষার অর্থ কী?
অনেক সময় আমরা ফলাফল নিয়ে এতটাই চিন্তিত হয়ে পড়ি যে, কাজটি করার আগ্রহ হারিয়ে ফেলি। ধরুন, আপনি একটি পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। যদি আপনি শুধুই ফলাফলের কথা ভাবতে থাকেন—‘আমি কি প্রথম হব?’, ‘আমি কি ভালো চাকরি পাব?’—তাহলে আপনার প্রস্তুতিতে বাধা আসবে। আপনি পরীক্ষার বিষয়ে মনোযোগ দিন, ফলাফল আপনা-আপনি আসবে।

অপারিগ্রহের নীতি: ফলাফলের আকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করার শিক্ষা

গীতার ৩.১৯ শ্লোকে বলা হয়েছে:
“তস্মাদসক্তঃ সততং কর্ম কার্যং সমাচর।
অসক্তোহ্যাচরণং কর্ম পরমাপ্নোতি পুরুষঃ।”
অর্থাৎ, ফলাফলের প্রতি আকাঙ্ক্ষা ছাড়াই কর্ম করুন, এভাবেই একজন ব্যক্তি পরম সাফল্যে পৌঁছাতে পারে।

ধরুন, আপনি কোনো সামাজিক সেবামূলক কাজে যুক্ত হয়েছেন। যদি আপনি সেই কাজটি শুধুই প্রশংসা বা পুরস্কারের জন্য করেন, তবে আপনার কাজের আসল তাৎপর্য হারিয়ে যাবে। কিন্তু যদি আপনি আপনার আন্তরিকতা দিয়ে কাজটি করেন, সমাজ উপকৃত হবে এবং আপনি নিজেও আনন্দ অনুভব করবেন।

কর্মযোগ: জীবনের আসল পথ

গীতা বলে, “যোগঃ কর্মসু কৌশলম্।”
অর্থাৎ, যোগ হচ্ছে কাজের দক্ষতা। এর মানে হলো, আমাদের কাজের মধ্যেই সৃষ্টির উপাসনা লুকিয়ে আছে। আপনি যে কাজই করুন, সেটিকে পরম আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সঙ্গে সম্পন্ন করুন।

একজন মাটির কুমোরের উদাহরণ নিন। তিনি হয়তো মনে করেন, “আমি শুধুমাত্র পাত্র তৈরি করছি।” কিন্তু যদি তিনি জানেন যে তার কাজটি সমাজে একটি বড় ভূমিকা রাখে—যেমন, সেই পাত্রে মানুষ পানি বা খাবার সংরক্ষণ করবে—তাহলে তার কাজের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে যাবে।

সংঘর্ষে ধৈর্যের শিক্ষা

জীবনে কঠিন সময় আসবেই। গীতার ২.৩৮ শ্লোকে বলা হয়েছে:
“সুখদুঃখে সমে কৃত্বা লাভালাভৌ জয়াজয়ৌ।
ততো যুদ্ধায় যুজ্যস্ব নৈवं পাপমবাপ্স্যসি।”
অর্থাৎ, সুখ-দুঃখ, লাভ-ক্ষতি, এবং জয়-পরাজয়কে সমানভাবে গ্রহণ করে কাজ করুন।

একজন খেলোয়াড়ের জীবনের কথা ভাবুন। সে প্রতিদিন কঠোর অনুশীলন করে, জয়ের আকাঙ্ক্ষায়। কিন্তু সে যদি কেবল জয়ের চিন্তা করে, তাহলে পরাজয়ের সময় হতাশ হয়ে যাবে। গীতা শেখায়, কাজের প্রতি যত্নবান হন, ফলাফল স্বাভাবিকভাবে আসবে।

আত্ম-সমর্পণের শিক্ষা

গীতার ১৮.৬৬ শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণ বলেন:
“সর্বধর্মান্পরিত্যজ্য মামেিকং শরণং ব্রজ।
অহং ত্বাং সর্বপাপে ভ্যো মোক্ষয়িষ্যামি মা শুচঃ।”
অর্থাৎ, নিজের সমস্ত দায়িত্ব ও চিন্তা আমাকে সমর্পণ কর। আমি তোমাকে সমস্ত পাপ থেকে মুক্ত করব।

এটি মানসিক শান্তির একটি শক্তিশালী বার্তা। আপনি যদি অনুভব করেন যে, আপনার সব দায়িত্ব ঈশ্বরের হাতে সঁপে দিয়েছেন, তাহলে আপনার মন শান্ত থাকবে এবং আপনি আরও দক্ষতার সঙ্গে কাজ করতে পারবেন।

প্রাসঙ্গিক উদাহরণ

গীতার শিক্ষাগুলি কেবল ধর্মীয় নয়, এটি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের জন্যও প্রাসঙ্গিক।

  • পেশাগত জীবনে: অফিসে কোনো কঠিন কাজ করতে গিয়ে ফলাফলের ভয় নিয়ে চিন্তা করবেন না। আপনার কাজের প্রতি মনোযোগ দিন।
  • ব্যক্তিগত সম্পর্ক: প্রিয়জনের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখতে নিজের দায়িত্ব পালন করুন, প্রত্যুত্তরের জন্য অপেক্ষা করবেন না।
  • সমাজসেবা: অন্যের সাহায্য করুন বিনিময়ে কিছু আশা না করে।

গীতার বার্তা আপনার জীবনে কীভাবে প্রভাব ফেলবে?

গীতা আমাদের শেখায় যে, জীবন হলো একটি যাত্রা এবং কাজ হলো সেই যাত্রার গতি। আপনি যদি ফলাফলের চিন্তা ত্যাগ করে কাজ করতে পারেন, তাহলে আপনার জীবন অনেক সহজ ও সুখময় হবে।

শেষে আমি আপনাকে একটি প্রশ্ন রেখে যেতে চাই:
“আপনার জীবনের প্রতিদিনের কাজগুলো কি আপনি শ্রীকৃষ্ণের এই উপদেশ অনুযায়ী করছেন?”
ভেবে দেখুন, কারণ গীতার শিক্ষার আলোয় আপনার জীবনের পথ আলোকিত হতে পারে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top