গীতার মাধ্যমে অর্জুন কী ধরনের জ্ঞান লাভ করেছিলেন?

আমি নিশ্চিত, তোমরা সবাই মহাভারতের সেই বিখ্যাত অধ্যায়টির কথা জানো যেখানে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে উপদেশ দিয়েছিলেন। যুদ্ধক্ষেত্রের মাঝখানে অর্জুন যখন নিজের কর্তব্য ও নৈতিকতার প্রশ্নে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন, তখন শ্রীকৃষ্ণের দেওয়া জ্ঞান কেবল অর্জুনের নয়, আমাদের সকলের জীবন পরিবর্তন করার মতো। এই ব্লগে আমি তোমাকে সেই অমূল্য জ্ঞানের কিছু দিক বোঝানোর চেষ্টা করব।

 কর্তব্য এবং ধর্মের প্রকৃত অর্থ

যখন অর্জুন কুরুক্ষেত্রের ময়দানে দাঁড়িয়ে আত্মীয়-স্বজনদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে দ্বিধাগ্রস্ত হচ্ছিলেন, শ্রীকৃষ্ণ তাকে বললেন, “কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন।” অর্থাৎ, তোমার কাজ করার অধিকার আছে, কিন্তু কাজের ফলাফল নিয়ে চিন্তা করার কোনো প্রয়োজন নেই।

শ্রীকৃষ্ণের এই উক্তি আমাদের শিক্ষা দেয় যে জীবনে আমাদের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত নিজের কর্তব্য পালন করা। তুমি যদি নিজের কাজকে সঠিকভাবে সম্পন্ন করো, তাহলে ফলাফল আপনা থেকেই আসবে। ধরো, তুমি একজন ছাত্র। তোমার কাজ হলো মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করা। কিন্তু যদি তুমি সারাক্ষণ পরীক্ষার ফল নিয়ে দুশ্চিন্তা করো, তাহলে কি পড়ায় মন বসবে? তাই, গীতার এই শিক্ষা তোমার জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে কাজে লাগতে পারে।

 আত্মজ্ঞান ও জীবনের উদ্দেশ্য

শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলেছিলেন, “আত্মানং বিদ্ধি”, অর্থাৎ নিজের আত্মাকে জানো। এই আত্মজ্ঞানই মানুষের জীবনের আসল লক্ষ্য। অর্জুন প্রথমে ভেবেছিলেন, এই যুদ্ধ শুধুই ভৌত অস্তিত্বের লড়াই। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ তাকে বোঝালেন যে এই পৃথিবী অস্থায়ী এবং আত্মা অমর।

তুমি কি কখনো ভেবেছো, আমরা কেন এখানে এসেছি? জীবনের উদ্দেশ্য কী? গীতা আমাদের শেখায় যে জীবনের আসল লক্ষ্য হলো নিজের আত্মাকে চিনতে পারা এবং পরমাত্মার সাথে মিলিত হওয়া। ধরো, তুমি একটি কাজ করছো, কিন্তু সেই কাজের পেছনে যদি কোনো গভীর অর্থ না থাকে, তাহলে কি তুমি সেই কাজ করে সুখী হবে? ঠিক তেমনি, জীবনের প্রকৃত অর্থ বুঝতে হলে আত্মজ্ঞান অপরিহার্য।

 সমতা ও স্থিতি

শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, “সমত্বং যোগ উচ্যতে।” অর্থাৎ, জীবনের প্রতিটি অবস্থায় সমানভাবে স্থিতিশীল থাকা উচিত। সুখ-দুঃখ, লাভ-ক্ষতি, জয়-পরাজয় – এগুলো জীবনের অংশ।

তোমার কি মনে পড়ে, যখন তুমি কোনো প্রতিযোগিতায় হেরে গিয়েছিলে? তখন কেমন অনুভব করেছিলে? আবার যখন তুমি জিতেছিলে, তখন কি সেই সুখ চিরস্থায়ী ছিল? এই সব অনুভূতি ক্ষণস্থায়ী। গীতার শিক্ষা হলো, জীবনের উত্থান-পতনের মধ্যে ভারসাম্য রাখা। এতে মন শান্ত থাকবে এবং তুমি আরো ভালোভাবে নিজের লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবে।

 ভয়ের উপর জয় লাভ

অর্জুন যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে ভীত ছিলেন। তিনি নিজের ভয় নিয়ে শ্রীকৃষ্ণের কাছে অভিযোগ করেন। তখন শ্রীকৃষ্ণ তাকে বলেন, “ক্ষুদ্রং হৃদয় দৌর্বল্যং ত্যক্তোত্তিষ্ঠ পরন্তপ।” অর্থাৎ, হৃদয়ের এই ক্ষুদ্র দুর্বলতাকে ত্যাগ করো এবং উঠে দাঁড়াও।

তুমি কি জীবনে কখনো এমন অবস্থায় পড়েছো যেখানে ভয় তোমার অগ্রগতির পথে বাধা সৃষ্টি করেছে? হয়তো একটি বড়ো সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে, কিংবা জীবনের কোনো নতুন চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে গিয়ে। গীতা আমাদের শেখায়, ভয় হলো মানসিক বাধা। একবার তুমি এই ভয়কে জয় করতে পারলে, তখন তোমার জীবন এক নতুন পথে এগিয়ে যাবে।

নিষ্কাম কর্ম

গীতার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হলো “নিষ্কাম কর্ম”। শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বোঝান যে কোনো কাজ করার সময় সেই কাজের প্রতি একাগ্রতা ও নিষ্ঠা থাকা উচিত, কিন্তু সেই কাজের ফলাফলের প্রতি আসক্ত হওয়া উচিত নয়। তিনি বলেন, “যোগঃ কর্মসু कौशलम्।” অর্থাৎ, দক্ষতার সাথে কাজ করা এবং ফলাফলের চিন্তা ছেড়ে দেওয়াই যোগ।

তুমি যদি কোনো কাজে নিজের সর্বোচ্চটা দাও, কিন্তু ফলাফল নিয়ে দুশ্চিন্তা না করো, তাহলে সেই কাজ তোমার জন্য আনন্দের হয়ে উঠবে। ধরো, তুমি একটি প্রজেক্টে কাজ করছো। যদি তুমি কেবল ফল নিয়ে চিন্তা করো, তাহলে কি কাজটি উপভোগ করতে পারবে? বরং কাজের প্রতি মনোযোগ দিলে তুমি আরও ভালো ফলাফল পাবে।

উদাহরণ থেকে শিক্ষা

  •  যখন অর্জুন তার নিজের ভাইদের বিরুদ্ধে তীর ছোঁড়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি, তখন শ্রীকৃষ্ণ তাকে বলেছিলেন, “যুদ্ধে তোমার ধর্ম পালন করো।” 
  •  তিনি আরও বলেছিলেন, “এই যুদ্ধ তোমার জন্য একটি পরীক্ষা, যেখানে তোমার চরিত্র এবং কর্তব্য পরিমাপ করা হবে।” 
  •  অর্জুনের দ্বিধাগ্রস্ত মনোভাব কাটিয়ে ওঠার জন্য শ্রীকৃষ্ণ তাকে আত্মবিশ্বাস জাগ্রত করার মন্ত্র দিয়েছিলেন।

উপসংহার

তুমি কি ভেবেছো, গীতার এই শিক্ষাগুলো তোমার জীবনে কিভাবে প্রাসঙ্গিক হতে পারে? শ্রীকৃষ্ণের উপদেশ অর্জুনকে কেবল যুদ্ধে জেতার জন্য নয়, বরং জীবনকে গভীরভাবে বোঝার জন্য সাহায্য করেছিল। আজকের যুগে, যখন আমরা নানা সমস্যায় জর্জরিত, গীতার এই শিক্ষাগুলো আমাদের জন্য এক মহামূল্যবান দিশা হতে পারে।

তাহলে, তুমি কি গীতার শিক্ষা নিজের জীবনে প্রয়োগ করার জন্য প্রস্তুত? মহাভারতের এই অমূল্য জ্ঞান তোমার জীবনকে কতটা বদলাতে পারে, তা তুমি নিজেই আবিষ্কার করো।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top