দুর্যোধনের দুষ্ট আচরণের জন্য ধৃতরাষ্ট্র এবং গন্ধারীর দায়িত্ব কতটুকু?

মহাভারত আমাদের জীবনের প্রতিটি কোণে শিক্ষা প্রদান করে। দুর্যোধনের গল্প আমাদের শেখায়, এক নেতিবাচক চরিত্র কিভাবে পরিবার এবং সমাজকে বিপর্যস্ত করতে পারে। কিন্তু আমরা যদি একটু গভীরে যাই, তবে প্রশ্ন জাগে, দুর্যোধনের দুষ্ট আচরণের জন্য তার পিতা-মাতা, ধৃতরাষ্ট্র এবং গন্ধারীর কতটা দায়িত্ব রয়েছে?

আমি মনে করি, আমাদের প্রথমেই দেখতে হবে তাদের ভূমিকা এবং দুর্যোধনের প্রতি তাদের মনোভাব। আপনি এবং আমি যখন কোনো বিষয়ে বিশ্লেষণ করি, তখন আমাদের সব দিক বিবেচনা করা উচিত। চলুন মহাভারতের কাহিনি থেকে প্রাসঙ্গিক উদাহরণ এবং উক্তি ব্যবহার করে এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করি।

ধৃতরাষ্ট্রের ভূমিকা

ধৃতরাষ্ট্র, কৌরবদের পিতা, একজন অন্ধ রাজা। কিন্তু তার অন্ধত্ব শুধু দৃষ্টির সীমাবদ্ধতায় নয়, মনের অন্ধত্বেও প্রকাশ পায়। তিনি সবসময় দুর্যোধনের ভুল কাজগুলো দেখেও এড়িয়ে গেছেন।

মহাভারতে একটি উক্তি আছে:

“যে ব্যক্তি অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয়, সে নিজেও অন্যায়কারী।”

ধৃতরাষ্ট্র এই ভুলটি বারবার করেছেন। দুর্যোধন যখন পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছে, তখন তিনি কখনো বাধা দেননি। উদাহরণস্বরূপ, যখন দুর্যোধন দ্যূতসভায় দ্রৌপদীর অপমানের আয়োজন করে, তখন ধৃতরাষ্ট্র উপস্থিত ছিলেন। তিনি দ্রৌপদীর প্রতি সামান্য সমবেদনা দেখালেও দুর্যোধনকে শাসন করেননি।

কেন এমনটা হলো? কারণ ধৃতরাষ্ট্র নিজের পুত্রের প্রতি অন্ধ ভালোবাসা এবং তার প্রতি তার দুর্বলতার কারণে। আপনি কি লক্ষ্য করেছেন, পিতা-মাতার এই ধরনের পক্ষপাতিত্ব কীভাবে একটি সন্তানের চরিত্র গঠনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে? এটা আমাদের প্রতিদিনের জীবনেও ঘটে।

গন্ধারীর ভূমিকা

গন্ধারী, দুর্যোধনের মা, ছিলেন এক মহৎ নারী। তিনি স্বেচ্ছায় নিজের চোখ বাঁধেন ধৃতরাষ্ট্রের সাথে সমব্যথী হতে। কিন্তু এই কাজের মাধ্যমে তিনি এক অর্থে নিজের সন্তানদের সঠিক পথ দেখানোর ক্ষমতা হারান।

মহাভারতে বলা হয়েছে:

“ধর্মের পথ প্রদর্শন না করলে পিতামাতা সন্তানের প্রতি পাপ করে।”

গন্ধারী অনেক সময় দুর্যোধনকে শাসন করেছেন, তাকে সঠিক পথে আনার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু দুর্যোধনের চরিত্রে পরিবর্তন আনতে তার এই চেষ্টাগুলো যথেষ্ট ছিল না। উদাহরণস্বরূপ, যখন দুর্যোধন পাণ্ডবদের হরণ করার পরিকল্পনা করেছিল, তখন গন্ধারী তাকে সাবধান করেছিলেন। কিন্তু দুর্যোধনের জেদ এবং অহংকার তাকে সেই পথ থেকে সরাতে পারেনি। গন্ধারীর এই সীমাবদ্ধতার কারণ কি ছিল? তার একদিকে ছিল স্বামীর প্রতি আনুগত্য এবং অন্যদিকে ছিল সন্তানদের প্রতি ভালোবাসা। এই দ্বিধার কারণে তিনি কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারেননি।

দুর্যোধনের আচরণের কারণ

আপনার কি মনে হয়, শুধুমাত্র ধৃতরাষ্ট্র এবং গন্ধারীর দায়িত্বে দুর্যোধনের চরিত্র গঠিত হয়েছে? আসলে, এটি একটি জটিল প্রক্রিয়া। পারিবারিক পরিবেশ, সমাজের প্রভাব এবং দুর্যোধনের নিজের মানসিকতা এখানে বড় ভূমিকা পালন করেছে।

মহাভারতে কৃষ্ণ বলেন:

“মানুষের কর্মই তার ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে।”

দুর্যোধন তার কর্মের ফল ভোগ করেছে। কিন্তু তার পিতা-মাতার পক্ষপাতিত্ব এবং ভুল সিদ্ধান্ত তাকে এমন কর্মে উৎসাহিত করেছিল। উদাহরণস্বরূপ, ধৃতরাষ্ট্র সব সময় দুর্যোধনকে পাণ্ডবদের চেয়ে বেশি সুযোগ দিয়েছেন। গন্ধারীও দুর্যোধনের অতি আবেগী স্বভাবকে সামলানোর ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছেন।

আমাদের শিক্ষা

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আপনি এবং আমি এই গল্প থেকে কী শিক্ষা নিতে পারি? পিতা-মাতার পক্ষপাতিত্ব সন্তানের মধ্যে বিদ্বেষ এবং অহংকারের জন্ম দিতে পারে। আপনি যদি একজন অভিভাবক হন, তবে আপনার কাজ হবে আপনার সন্তানদের সঠিক পথে পরিচালিত করা। তাদের ভুল কাজকে প্রশ্রয় দেওয়া মানে তাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার করা।

আমরা যদি মহাভারতের কথা স্মরণ করি, তবে শিখতে পারি যে সঠিক মূল্যবোধ এবং ন্যায়পরায়ণতা সন্তানদের জীবনে কতটা গুরুত্বপূর্ণ।

উপসংহার

ধৃতরাষ্ট্র এবং গন্ধারী দুর্যোধনের দুষ্ট আচরণের জন্য পুরোপুরি দায়ী না হলেও, তাদের ভূমিকা অবজ্ঞা করা যায় না। তাদের সীমাবদ্ধতা এবং ভুল সিদ্ধান্ত দুর্যোধনের দুষ্ট স্বভাবকে বাড়িয়ে তুলেছিল। আপনি কি কখনো ভেবে দেখেছেন, আপনার জীবনেও কোনো ভুল সিদ্ধান্ত বা পক্ষপাতিত্ব আপনার চারপাশের মানুষের উপর কী প্রভাব ফেলছে? মহাভারতের এই শিক্ষা আপনার এবং আমার জীবনের জন্য কতটা মূল্যবান, তা একবার ভাবুন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top