মহাভারত, আমাদের জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিক্ষার আধার। যখন আমি এই মহাকাব্যের গভীরে প্রবেশ করি, তখন এর প্রতিটি ঘটনা যেন জীবনের এক এক অধ্যায় হয়ে ওঠে। একবার ভাবুন, দ্রৌপদীর দুর্যোধনের সভায় অপমানের সেই মুহূর্তটি। কি নির্মম দৃশ্য! তবে, আপনি কি কখনো ভেবেছেন, এটি কি কেবল এক নারীর প্রতি অপমান, নাকি এর গভীরে শ্রেণী বৈষম্যের দৃষ্টান্ত লুকিয়ে রয়েছে?
দ্রৌপদীর পরিচয়: ক্ষমতা ও শ্রেণীর সংঘাত
দ্রৌপদী ছিলেন একাধারে পঞ্চপাণ্ডবের স্ত্রী এবং পাঞ্চাল রাজ্যের কন্যা। সমাজে তাঁর উচ্চ মর্যাদা এবং বুদ্ধিমত্তা তাঁকে অন্য নারীদের থেকে আলাদা করে তুলেছিল। কিন্তু দুর্যোধন, যিনি কৌরব রাজপরিবারের উত্তরাধিকারী, দ্রৌপদীর এই মর্যাদা এবং শ্রেণীকে হেয় প্রতিপন্ন করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন।
“ধর্মান্নেব ধর্মং যদপহন্যাদধর্মং ধর্মমিতি মন্যতে। তেসাং সাধূন্যত্র প্রকৃতিরধর্মস্য চ ধর্মমং মনে।”— মহাভারত, বনপর্ব।
(অধর্মকে ধর্ম বলে মানা এবং ধর্মকে অধর্ম বলে ভাবা, এটি প্রকৃত পাপের পরিচয়।)
এই উদ্ধৃতি স্মরণ করিয়ে দেয় যে দুর্যোধনের কাজ কেবল দ্রৌপদীর প্রতি নয়, বরং সমাজের ন্যায়বিচার এবং শ্রেণীগত ভারসাম্যের উপর আঘাত।
শ্রেণী বৈষম্যের উদাহরণ
- যুদ্ধে অর্জিত দ্রৌপদীকে সম্পত্তি হিসেবে গণ্য করা
যখন যুধিষ্ঠির পাশা খেলায় দ্রৌপদীকে হেরে যান, তখন দুর্যোধন দ্রৌপদীকে ‘দাসী’ হিসেবে দাবি করেন। এটি কেবল নারীকে অপমান করা নয়, বরং সমাজের নিম্নশ্রেণীর প্রতি যে অবজ্ঞা, তারও প্রতিফলন।
“দাসীবৎ দ্রৌপদীম আনেৎ।” (দ্রৌপদীকে দাসীর মতো নিয়ে এসো।)
এই উক্তি শ্রেণী বৈষম্যের কুৎসিত মুখ তুলে ধরে।
- ভরা সভায় অপমান
কুরুরাজসভায় দ্রৌপদীর চুল ধরে টেনে আনা এবং তাঁর শাড়ি খুলে নেওয়ার চেষ্টা কেবল তাঁর মর্যাদাকে আঘাত করেনি, বরং সমাজের উচ্চশ্রেণী এবং নারীদের প্রতি এক বিদ্বেষপূর্ণ বার্তা দিয়েছে। দুর্যোধনের এই কাজ সমাজের নীচু স্তরে থাকা মানুষকে বারবার মনে করিয়ে দেয় যে তাঁরা ক্ষমতাশালীদের ক্রীতদাস। - ভিন্ন শ্রেণীর প্রতি ঘৃণা
দুর্যোধন দ্রৌপদীর প্রতি এমন একটি আচরণ করেছিলেন যা তাঁর প্রতি ব্যক্তিগত রাগ নয়, বরং পাণ্ডবদের শ্রেণীকে হেয় প্রতিপন্ন করার প্রচেষ্টা। এটি প্রমাণ করে যে ক্ষমতাশালী শ্রেণী কীভাবে দুর্বলদের ওপর আধিপত্য বিস্তার করে।
মহাভারতের শিক্ষণীয় দিক
মহাভারত আমাদের জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে শিক্ষা দিয়ে যায়। আপনি যদি দ্রৌপদীর অপমানের ঘটনাটি গভীরভাবে বিশ্লেষণ করেন, তবে দেখতে পাবেন এটি শুধুমাত্র এক নারীর মর্যাদার প্রশ্ন নয়, বরং সমাজের শ্রেণী বৈষম্যের চিত্র।
“ন হি ধর্মং চ্যুতধর্মেণ ধর্ম্মস্যাপি গমিষ্যতি।” (অধর্ম দ্বারা ধর্ম কখনো প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না।)
দুর্যোধনের কর্মকাণ্ড এই বার্তাকে প্রমাণ করে যে অধর্মের উপর ভিত্তি করে গড়া সমাজ কখনো টিকে থাকতে পারে না।
আপনার জীবনে মহাভারতের প্রতিফলন
আমি মনে করি, আপনি এবং আমিও কখনো কখনো সমাজের শ্রেণী বৈষম্যের শিকার হই। একবার ভাবুন, কর্মক্ষেত্রে বা পারিবারিক জীবনে এমন পরিস্থিতি কি আসে না যেখানে ক্ষমতাশালী শ্রেণী আপনাকে হেয় প্রতিপন্ন করতে চায়? মহাভারত বলে, “ধর্মকে রক্ষা করুন, ধর্ম আপনাকে রক্ষা করবে।” আমরা যদি ন্যায়বিচার এবং মানবিকতার পথে থাকি, তবে শ্রেণী বৈষম্যের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর শক্তি আমাদের মধ্যে থাকবে।
উপসংহার
দ্রৌপদীর অপমান কেবল তাঁর ব্যক্তিগত লজ্জার কাহিনী নয়; এটি সমাজের প্রতি এক বার্তা যে শ্রেণী বৈষম্য ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়। আপনি কি কখনো ভেবেছেন, আমরা যদি মহাভারতের এই শিক্ষাগুলো বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করি, তবে আমাদের সমাজ কতটা ন্যায়বিচারপূর্ণ হতে পারে?