আপনি কি কখনো এমন একজন পিতার কথা ভেবেছেন, যিনি নিজের সন্তানদের প্রতি অন্ধপ্রেমে তাদের সঠিক পথে নিয়ে আসতে ব্যর্থ হয়েছেন? মহাভারতের ধৃতরাষ্ট্র সেই পিতাদের প্রতীক, যাঁরা দায়িত্ব ও আবেগের ভারসাম্য বজায় রাখতে পারেননি।
ধৃতরাষ্ট্র: এক অসহায় পিতা, না কি ক্ষমতার অন্ধ দাস?
ধৃতরাষ্ট্র ছিলেন হস্তিনাপুরের রাজা, কিন্তু তাঁর অন্ধত্ব শুধু শারীরিক ছিল না—সেটি নৈতিকতার অন্ধত্বেও রূপ নিয়েছিল। তিনি প্রায়শই তাঁর সন্তানদের অন্যায় আচরণে চুপ ছিলেন। কিন্তু কেন? কারণ তিনি মনে করতেন, সন্তানের ভুলের বিরোধিতা করলে হয়তো তাঁর সন্তানদের ভালোবাসা হারাবেন।
একটি প্রশ্ন: পিতার ভালোবাসা কি কখনো সত্যের ওপর বিজয়ী হতে পারে?
মহাভারতে বলা হয়েছে:
“ধর্ম সর্বত্র প্রতিষ্ঠিত হওয়া উচিত, অন্যথায় সমাজের পতন অনিবার্য।”
ধৃতরাষ্ট্রের এই মৌনতা কি তাঁর সন্তানদের সম্মান অর্জনের জন্য যথেষ্ট ছিল? তা আমাদের বিশ্লেষণ করতে হবে।
দুর্যোধনের অহংকার: পিতার দুর্বলতার ফসল
ধৃতরাষ্ট্রের বড় ছেলে দুর্যোধন ছিলেন অত্যন্ত অহংকারী এবং ক্ষমতালিপ্সু। দুর্যোধন কখনো তাঁর পিতাকে প্রকৃত অর্থে সম্মান করেননি। বরং, ধৃতরাষ্ট্রের স্নেহকে দুর্যোধন নিজের উদ্দেশ্য পূরণের হাতিয়ার বানিয়েছিল।
উদাহরণ:
যখন দুর্যোধন দ্রৌপদীর অপমানের পরিকল্পনা করে, ধৃতরাষ্ট্র সেটা থামাতে পারতেন। কিন্তু তিনি চুপ থেকেছিলেন। তখন দ্রৌপদী রাজসভায় কেঁদে বলেছিলেন:
“ধর্মরাজ, এটা কি আপনার ন্যায়বিচার? রাজা কি ন্যায় প্রতিষ্ঠা করবেন না?”
এই সময় ধৃতরাষ্ট্র যদি দৃঢ় পদক্ষেপ নিতেন, তবে দুর্যোধনের অহংকারে লাগাম টানা সম্ভব হতো।
বিদুরের উপদেশ: শ্রদ্ধার অভাবে উপেক্ষিত
মহাভারতে বিদুর ছিলেন জ্ঞান ও ন্যায়ের প্রতীক। তিনি ধৃতরাষ্ট্রকে বারবার সতর্ক করেছিলেন যে সন্তানের প্রতি অন্ধ ভালোবাসা একদিন পরিবার ও সমাজ উভয়েরই সর্বনাশ করবে।
বিদুর একবার বলেছিলেন:
“যে পিতা সন্তানের অন্যায়ে মৌন থাকে, সে পিতা নয়, সে সন্তানের শত্রু।”
আপনি কি মনে করেন, ধৃতরাষ্ট্র বিদুরের উপদেশকে যথাযথ গুরুত্ব দিয়েছিলেন? বিদুরের মতো ব্যক্তিত্বের পরামর্শ না মানার ফলেই ধৃতরাষ্ট্র সন্তানদের কাছ থেকে প্রকৃত সম্মান হারিয়েছিলেন।
কুন্তীর দৃষ্টিকোণ: অন্য পিতার এক কঠিন প্রশ্ন
কুন্তী, যিনি দুর্যোধন ও তাঁর ভাইদের কুটনৈতিক চক্রান্তের শিকার হয়ে তাঁর সন্তানদের সঙ্গে অরণ্যে কাটাতে বাধ্য হয়েছিলেন, ধৃতরাষ্ট্রকে একবার প্রশ্ন করেছিলেন:
“রাজা, আপনি কি একজন পিতা, না কি একজন নিঃসাড় দর্শক?”
এই প্রশ্ন ধৃতরাষ্ট্রের পিতৃত্বকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করে। একজন পিতা কি সন্তানের দোষ ঢেকে দিয়ে তার প্রকৃত সম্মান পেতে পারেন?
অর্জুন ও যুধিষ্ঠির: পিতার প্রতি যথাযথ সম্মান
পাণ্ডবরা কখনো ধৃতরাষ্ট্রকে অসম্মান করেননি। যুধিষ্ঠির বরাবর ধৃতরাষ্ট্রকে “পিতা” বলে সম্বোধন করেছেন এবং তাঁর পরামর্শ মেনে চলার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তাঁদের এই সম্মান কি ধৃতরাষ্ট্র অর্জন করেছিলেন, নাকি এটি তাঁদের চরিত্রের মহত্ত্বের কারণে ছিল?
মহাভারতে একটি সুন্দর শ্লোক রয়েছে:
“সত্য ও ধর্মের পথে চলাই পিতাকে শ্রদ্ধা করার প্রকৃত পন্থা।”
এটি স্পষ্ট যে ধৃতরাষ্ট্র তাঁর সন্তানদের কাছ থেকে প্রকৃত অর্থে সম্মান অর্জন করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন।
ধৃতরাষ্ট্রের পরিণতি: এক অন্ধকার অধ্যায়
মহাভারতের শেষে ধৃতরাষ্ট্র যখন সমস্ত কিছু হারিয়েছেন, তখন তিনি বিদুর ও কৃতজ্ঞ পাণ্ডবদের সাহায্যে বনের পথে গিয়েছিলেন। এই সময় তাঁর মনে হয়েছিল যে তিনি তাঁর জীবন নষ্ট করেছেন।
উপসংহার:
আপনি কি কখনো ভেবেছেন, ধৃতরাষ্ট্র যদি দুর্যোধনের অন্যায়ের প্রতিবাদ করতেন, তাহলে তাঁর পরিণতি কি বদলাতে পারত? মহাভারত আমাদের শিক্ষা দেয় যে সত্য ও ধর্মের পথে চলার জন্য সাহসিকতা প্রয়োজন।
ভাবার জন্য একটি প্রশ্ন
তাহলে, আপনি নিজে কী করবেন? আপনি কি ধৃতরাষ্ট্রের মতো সন্তানের ভুলে চোখ বন্ধ করে থাকবেন, নাকি ন্যায়ের পথে দৃঢ় পদক্ষেপ নেবেন? মহাভারতের শিক্ষা গ্রহণ করে চলুন, কারণ এটি আপনার জীবনকে পরিবর্তন করতে পারে।