ধৃতরাষ্ট্র কি তার সন্তানদের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট ছিলেন?

আপনি কি কখনো ভেবে দেখেছেন, এক রাজা হয়ে ধৃতরাষ্ট্র কীভাবে তার সিদ্ধান্তে পক্ষপাতদুষ্ট ছিলেন? মহাভারতের গল্পের প্রতিটি মোড়ে আমরা দেখতে পাই তার সন্তানদের প্রতি অতিরিক্ত ভালোবাসা ও পক্ষপাতের কারণেই অনেক অনিষ্ট ঘটেছে। আজ আমি আপনাকে এই প্রসঙ্গে কিছু গল্প শোনাবো, কিছু শ্লোক তুলে ধরবো এবং আপনার জীবনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ পাঠ শেয়ার করবো।

ধৃতরাষ্ট্রের পক্ষপাত: এক রাজ্যের পতনের কারণ

ধৃতরাষ্ট্র ছিলেন হস্তিনাপুরের অন্ধ রাজা। কিন্তু তার অন্ধত্ব কেবল শারীরিক ছিল না; এটি ছিল নৈতিক অন্ধত্বেরও একটি প্রতিচ্ছবি। তিনি তার বড় ছেলে দুর্যোধনের প্রতি এতটাই পক্ষপাতদুষ্ট ছিলেন যে রাজ্যের ন্যায়ের তুলনায় সন্তানের অন্যায়কে বেশি গুরুত্ব দিতেন।

 দুর্যোধনের অন্যায় মেনে নেওয়া

দুর্যোধন বারবার পাণ্ডবদের অপমান করেছেন এবং তাদের সর্বস্ব কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছেন। মহাভারতে বলা হয়েছে:
“অধর্মো ধ্রুবমর্থায় তস্যৈব ফলদায়ক।”
অর্থাৎ, অন্যায় সর্বদাই নিজের ফল বয়ে আনে। ধৃতরাষ্ট্র এই সত্য জানতেন, তবুও দুর্যোধনের অন্যায় কাজে বাধা দেননি। যখন দুর্যোধন পাণ্ডবদের সম্পত্তি দখল করতে চাইলেন, ধৃতরাষ্ট্র চোখ বুজে সব মেনে নিলেন।

 জুয়ার আসরে নীরবতা

যখন দুর্যোধন ও শকুনির প্ররোচনায় যুধিষ্ঠির জুয়া খেলায় সব হারান, ধৃতরাষ্ট্র তখন কোনো উদ্যোগ নেননি। একজন রাজা হিসেবে ন্যায়ের পথে এগিয়ে যাওয়া তার দায়িত্ব ছিল। কিন্তু তিনি শুধু নীরব থেকে এই অন্যায় কার্যক্রমকে সমর্থন করেছিলেন। এক শ্লোকে বলা হয়েছে:
“ধৃতরাষ্ট্রো মহারাজ: ন চ কিঞ্চিদব্রবীত।”
এই নীরবতা এক পক্ষপাতদুষ্ট পিতার পরিচয় দেয়, যিনি সন্তানের অন্যায় কাজেও বাধা দিতে অক্ষম।

 দ্রৌপদীর অপমান

সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনা ছিল দ্রৌপদীর অপমান। দুর্যোধন যখন দ্রৌপদীকে সভায় টেনে এনে তার সম্মানহানি করতে চেয়েছিল, ধৃতরাষ্ট্র তা দেখেও বাধা দেননি। এই ঘটনার পর পাণ্ডবদের মধ্যে যে ক্ষোভ জন্মেছিল, তা শেষ পর্যন্ত কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। মহাভারতে বলা হয়েছে:
“ন ধর্মং ন ন্যায়ং পিতুর্বাক্যং শ্রুতে ব্যর্থং দুর্যোধনস্য চ পাপে।”
অর্থাৎ, ধৃতরাষ্ট্রের ধর্ম ও ন্যায় পালনে ব্যর্থতা তার পরিবারের পতন ডেকে আনে।

পক্ষপাতের ফলাফল: ধৃতরাষ্ট্রের শিক্ষা

আপনি কি কখনো ভেবেছেন, পক্ষপাতদুষ্ট হওয়ার এই প্রবণতা আমাদের জীবনে কী প্রভাব ফেলতে পারে? ধৃতরাষ্ট্রের কাহিনি আমাদের শিখায় যে ন্যায়ের পথে না চললে এবং সঠিক সিদ্ধান্ত না নিলে জীবন ধ্বংসের পথে চলে যায়।

 সন্তানদের নৈতিক শিক্ষা দিতে ব্যর্থ

ধৃতরাষ্ট্র যদি দুর্যোধনকে নৈতিকতার শিক্ষা দিতেন এবং তার ভুলগুলো শোধরানোর চেষ্টা করতেন, তবে হয়তো কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ এড়ানো যেত। দুর্যোধনের প্রতি তার অন্ধ ভালোবাসা তাকে একজন দায়িত্ববান পিতা হওয়ার পথে বাধা দিয়েছে।

 ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ

একজন রাজা হিসেবে ধৃতরাষ্ট্রের কর্তব্য ছিল সব নাগরিকের প্রতি সমান দৃষ্টি রাখা। কিন্তু তিনি তার নিজের পরিবারের স্বার্থের দিকে ঝুঁকে পড়েন। মহাভারতে বলা হয়েছে:
“যো ন কুরুতে ধর্মম্, ন স পিতার্মনি।”
অর্থাৎ, যে ন্যায়ের পথে চলে না, সে প্রকৃত অর্থে পিতা নয়।

মহাভারত থেকে জীবনের পাঠ

আপনার জীবনে ধৃতরাষ্ট্রের এই ভুল থেকে কী শিখতে পারেন?

 ন্যায় এবং ধর্মের পথে থাকা

মহাভারতের প্রতিটি অধ্যায়ে বারবার বলা হয়েছে, “ধর্মো রক্ষতি রক্ষিতঃ”। ধর্মকে রক্ষা করলে ধর্মও আপনাকে রক্ষা করবে। যদি আপনি পক্ষপাতদুষ্ট হন বা কোনো অন্যায় কাজে চোখ বুজে থাকেন, তবে জীবনে অশান্তি আসবে।

 সন্তানদের সঠিক শিক্ষা দিন

ধৃতরাষ্ট্রের একটি বড় শিক্ষা হলো, সন্তানদের ভুলে সমর্থন না দিয়ে তাদের সঠিক পথে চালিত করা। আপনার যদি নিজের সন্তানদের প্রতি অন্ধ ভালোবাসা থাকে, তবে তারা জীবনে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না।

আপনার সিদ্ধান্ত কী?

ধৃতরাষ্ট্রের গল্প আমাদের দেখায় যে পক্ষপাত শুধু পরিবার নয়, সমাজ এবং পুরো জাতিকেও ধ্বংসের পথে নিয়ে যেতে পারে। আপনি কীভাবে আপনার জীবনে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করবেন? মহাভারতের এই শিক্ষা নিয়ে নিজের জীবনে ধর্ম ও ন্যায়ের আলো ছড়ানোর চেষ্টা করবেন?

আপনার সিদ্ধান্ত কি ধৃতরাষ্ট্রের মতো হবে, নাকি যুধিষ্ঠিরের মতো? ভেবে দেখুন!

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top