পিতামাতার পক্ষপাতিত্ব কি দুর্যোধনের দুর্বৃত্ত আচরণের মূল কারণ?

পিতামাতার পক্ষপাতিত্ব কি দুর্যোধনের দুর্বৃত্ত আচরণের মূল কারণ?

যদি আমরা মহাভারতের গভীরে ঢুকে পড়ি, তবে দুর্যোধনের চরিত্র এবং তার কার্যকলাপের নেপথ্যের কারণ খুঁজে বের করার চেষ্টা করতে পারি। মহাভারত শুধুমাত্র এক ঐতিহাসিক মহাকাব্য নয়, এটি আমাদের জীবনের গভীর দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করে। এতে দেখানো ঘটনাগুলো আমাদের পারিবারিক, সামাজিক এবং ব্যক্তিগত জীবনের মূল নীতিগুলো বোঝাতে সহায়ক। আজ আমি এবং আপনি একসাথে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজব: দুর্যোধনের দুর্বৃত্ত আচরণের মূলে কি পিতামাতার পক্ষপাতিত্ব লুকিয়ে ছিল?

দুর্যোধনের জন্ম এবং তার শৈশব

আপনারা জানেন, দুর্যোধনের জন্ম ছিল অনেকটাই অলৌকিক। ধৃতরাষ্ট্র এবং গান্ধারী একটি শক্তিশালী বংশের উত্তরাধিকার চেয়েছিলেন। দুর্যোধনের জন্মের সময় থেকেই তাকে ‘বড় কিছু’ বানানোর ইচ্ছা তার পিতামাতার মধ্যে দেখা যায়। কিন্তু সমস্যা হলো, ধৃতরাষ্ট্র পক্ষপাতমূলক আচরণ শুরু করেন তার নিজের সন্তানদের প্রতি।

ধৃতরাষ্ট্রের অন্ধত্ব যেমন শারীরিক ছিল, তেমনই ছিল মানসিক। তিনি কখনো কৌরবদের ভুলত্রুটি দেখেননি। দুর্যোধনের শিশু বয়স থেকেই তার কার্যকলাপকে সমর্থন করা এবং প্রশ্রয় দেওয়া পিতার দায়িত্ববোধকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। পক্ষপাতিত্বের এই প্রাথমিক শিক্ষা দুর্যোধনের মনোজগতে গভীরভাবে প্রভাব ফেলে।

মহাভারত থেকে একটি দৃষ্টান্ত
যখন দুর্যোধন এবং ভীম ছোটবেলায় খেলায় মেতে উঠত, তখন দুর্যোধনের ঈর্ষা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ভীমের শক্তি দেখে দুর্যোধনের মন বিষাক্ত হয়ে ওঠে। দুর্যোধনের এই ঈর্ষাকাতর মনোভাবকে ধৃতরাষ্ট্র থামানোর বদলে প্রশ্রয় দিয়েছিলেন। আপনি কি দেখেন না, এই প্রশ্রয়ই দুর্যোধনের ভবিষ্যতের বিপর্যয়ের বীজ বুনেছিল?

পাণ্ডবদের প্রতি ঈর্ষা এবং পিতামাতার নীরবতা

আপনি যদি মহাভারত গভীরভাবে পড়েন, তবে দেখবেন, দুর্যোধনের সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল পাণ্ডবদের প্রতি ঈর্ষা। তিনি সবসময় ভাবতেন, কেন পাণ্ডবরা তার চেয়ে বেশি প্রশংসা পায়। যুধিষ্ঠিরের ধর্মনিষ্ঠা, অর্জুনের বীরত্ব এবং ভীমের শক্তি দুর্যোধনকে ক্রমাগত অস্থির করে তোলে।

এখানেই গান্ধারীর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। গান্ধারী একজন ধর্মপ্রাণা নারী হলেও তার সন্তানদের অন্যায় আচরণ নিয়ে কখনো সরাসরি প্রতিবাদ করেননি। তিনি যদি একজন শক্ত মায়ের ভূমিকা পালন করতেন এবং দুর্যোধনকে ভুল ও শুদ্ধের পার্থক্য শেখাতেন, তাহলে পরিস্থিতি ভিন্ন হতে পারত।

মহাভারতের আরেকটি উদাহরণ
রাজসভার সেই বিখ্যাত দৃশ্যটি মনে করুন, যেখানে দুর্যোধন দ্রৌপদীকে অপমান করার জন্য সভার মধ্যে টেনে আনে। তখনও ধৃতরাষ্ট্র পক্ষপাতমূলক আচরণ করে দুর্যোধনের কাজকে প্রশ্রয় দিয়েছিলেন। তিনি পাণ্ডবদের দোষারোপ করতে চেয়েছিলেন এবং তার সন্তানের অপমানজনক কার্যকলাপকে আড়াল করতে চেয়েছিলেন।

শাস্ত্রীয় দৃষ্টিভঙ্গি: পিতামাতার দায়িত্ব

আপনি কি কখনো ভেবে দেখেছেন, মহাভারত কেন পক্ষপাতিত্বের মতো একটি বিষয়কে এত গুরুত্ব দিয়েছে? কারণ এটি পরিবার ও সমাজের মূল ভিত্তিকে নাড়া দেয়।

শাস্ত্রে বলা হয়েছে,
“পুত্রণাং সংস্কারে পিতা কর্তব্যং প্রমত্ত:।”
অর্থাৎ, সন্তানের চরিত্র গঠনের জন্য পিতা-মাতার ভূমিকা অপরিহার্য। যদি পিতা-মাতা পক্ষপাতমূলক আচরণ করেন, তবে সন্তান ন্যায়-অন্যায়ের জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। দুর্যোধনের ক্ষেত্রেও এই পক্ষপাতমূলক আচরণ তার দুর্বৃত্ত মনোভাব গড়ে তুলতে সাহায্য করেছিল।

আপনার জীবনে এই শিক্ষা কিভাবে প্রাসঙ্গিক?

আপনি যদি পিতামাতা হন, তাহলে মহাভারতের এই শিক্ষাটি আপনার কাছে এক অমূল্য মণি হতে পারে। পিতা-মাতার উচিত সব সন্তানকে সমান দৃষ্টিতে দেখা। পক্ষপাতিত্ব শিশুদের মধ্যে ঈর্ষা, আত্মবিশ্বাসের অভাব এবং অন্ধকার মানসিকতার সৃষ্টি করে।

আপনার সন্তানরা যদি কোনো ভুল করে, তাদের প্রশ্রয় না দিয়ে ভুল থেকে শিক্ষা নিতে উৎসাহ দিন। আপনার ন্যায়পরায়ণ আচরণই তাদের সঠিক পথে পরিচালিত করবে।

উপসংহার

মহাভারত আমাদের শিখিয়েছে, পরিবার হলো একটি গাছের মতো, যার প্রতিটি শাখা সমান যত্ন এবং সুশিক্ষার প্রয়োজন। দুর্যোধনের চরিত্র আমাদের শেখায়, পক্ষপাতিত্ব শুধুমাত্র একজন ব্যক্তির নয়, পুরো সমাজের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top