মহাভারত, আমাদের প্রাচীন গ্রন্থগুলোর মধ্যে একটি অতুলনীয়, যা শুধুমাত্র ইতিহাস বা পৌরাণিক কাহিনীর বিবরণ নয়, বরং জীবনের গভীরতম দিকগুলোকে তুলে ধরে। এখানে আমরা দেখতে পাই, প্রতিটি চরিত্রের জীবনের দিকে নজর দিলে, তাদের পিতামাতার সিদ্ধান্তগুলোর কতটা গভীর প্রভাব পড়েছে। এমনকি আজকের দিনে আমরা যদি মহাভারতের শিক্ষাগুলোকে সঠিকভাবে গ্রহণ করতে পারি, তবে আমাদের নিজেদের জীবন এবং আমাদের সন্তানের জীবন উন্নতির পথে এগিয়ে যেতে পারে।
তবে, পিতামাতার সিদ্ধান্তের প্রভাব কি সত্যিই এতটাই বড়? মহাভারত কি আমাদের শেখায় যে, একজন সন্তান নিজের জীবন গড়তে পিতামাতার সিদ্ধান্ত থেকে বেরিয়ে আসতে পারে? চলুন, কিছু চরিত্রের জীবনের দিকে তাকিয়ে দেখি, যা আমাদের জন্য আজও প্রাসঙ্গিক।
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ এবং ধৃতরাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত
মহাভারতের প্রথম অধ্যায়ে, ধৃতরাষ্ট্রের সিদ্ধান্তগুলি তার নিজের এবং তার পরিবারের জীবনে অস্থিরতা সৃষ্টি করে। ধৃতরাষ্ট্রের অন্ধত্ব এবং তার পিতামাতার সিদ্ধান্তের প্রতি তার আনুগত্য, শেষ পর্যন্ত কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের দিকে নিয়ে যায়। ধৃতরাষ্ট্র যখন তার সন্তান দুর্যোধনকে সঠিক পথে না নিয়ে, অসৎ পথে পরিচালিত করতে থাকেন, তখন তার ফলস্বরূপ ঘটে বিপর্যয়।
ধৃতরাষ্ট্রের এই সিদ্ধান্ত এবং তার অনুগত ভূমিকা আমাদের শেখায়, পিতামাতার আদর্শগত সিদ্ধান্ত সন্তানের জীবনে বিশাল প্রভাব ফেলতে পারে। পিতামাতার আদর্শগত দৃষ্টিভঙ্গি যদি সঠিক না হয়, তাহলে সন্তানের জীবনও বিপথে চলে যেতে পারে।
মহাভারত থেকে উদ্ধৃতি:
“যথাযথ সিদ্ধান্ত না নিলে, পরিবার ধ্বংস হয়ে যায়।” (ধৃতরাষ্ট্র, মহাভারত)
ভীষ্ম পিতামহের অদ্বিতীয় সিদ্ধান্ত
পিতামাতার সিদ্ধান্ত কেবল একটি নেতিবাচক প্রভাব তৈরি করে না, কখনও কখনও এটি অত্যন্ত গুণগত ও মহৎ হতে পারে। ভীষ্ম পিতামহের জীবন এই ধরনের সিদ্ধান্তের এক নিখুঁত উদাহরণ। ভীষ্ম, যিনি স্বেচ্ছায় ব্রহ্মচর্য গ্রহণ করেছিলেন, তার পিতার সিদ্ধান্তের ফলস্বরূপ একটি কঠিন জীবন কাটিয়েছিলেন। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত তার জীবনে আত্মনির্ভরতা, শক্তি, এবং ধার্মিকতা নিয়ে এসেছিল।
ভীষ্মের সিদ্ধান্ত এবং জীবনবোধ আমাদের শেখায় যে, কখনও কখনও পিতামাতার সিদ্ধান্তগুলো যেভাবে আমাদের জীবনকে প্রভাবিত করে, তা আমাদের আরও শক্তিশালী এবং সঠিক পথে নিয়ে যেতে পারে।
মহাভারত থেকে উদ্ধৃতি:
“পিতামাতার সিদ্ধান্তের অধিকারী হয়ে, আমি সর্বদা ধর্মের পথে চলে এসেছি।” (ভীষ্ম পিতামহ, মহাভারত)
অর্জুনের দোটানা এবং কৃষ্ণের উপদেশ
অর্জুনের জীবনও পিতামাতার সিদ্ধান্তের প্রভাব দ্বারা প্রভাবিত হয়। তার পিতা, পাণ্ডু, তাকে দুনিয়ার রাজপুত্র হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন। কিন্তু যখন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ শুরু হয়, অর্জুন নিজের আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলেন। পিতার আদর্শকে অনুসরণ করতে গিয়ে, তিনি সিদ্ধান্ত নেন না যুদ্ধ করার। তার মধ্যে একধরনের দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। তবে, কৃষ্ণ তাকে উপদেশ দেন—”তুমি রাজবংশের সন্তান, তোমার কর্তব্য পালন করা তোমার কাছে একধরনের ধর্ম।”
এখানে দেখা যায় যে, পিতামাতার সিদ্ধান্তের প্রভাব একজন মানুষের জীবনে অবশ্যই পড়ে, কিন্তু সেই সিদ্ধান্তে নিজের মনোভাবের পাশাপাশি যদি একজন গুরু বা সঠিক পরামর্শদাতা থাকে, তবে সেই সিদ্ধান্তের পথ পরিবর্তন সম্ভব।
মহাভারত থেকে উদ্ধৃতি:
“তুমি যেহেতু রাজপুত্র, তোমার কর্তব্য পালন করাই হবে।” (কৃষ্ণ, মহাভারত)
দ্রৌপদী এবং তার পিতার সিদ্ধান্ত
দ্রৌপদীর জীবনও পিতামাতার সিদ্ধান্তের গভীর প্রভাব দেখায়। তার বাবা, ধৃপদ, দ্রৌপদীকে যেভাবে শিকাগ্রহণ করেছিলেন, সেই অনুযায়ী তার জীবন গড়ে উঠেছিল। তিনি যখন পাণ্ডবদের সঙ্গে বিবাহিত হন, তখন তার পিতার সিদ্ধান্ত তার ভবিষ্যৎ জীবনের প্রতিটি দিককে প্রভাবিত করে। কিন্তু, তার জীবনের সবচেয়ে বড় শিক্ষা ছিল যে, পিতামাতার সিদ্ধান্তের পরেও, একজন নারী নিজে নিজের পথ অনুসরণ করতে পারেন এবং তার জীবনের সিদ্ধান্ত তাকে সাফল্য ও মর্যাদা এনে দিতে পারে।
মহাভারত থেকে উদ্ধৃতি:
“আমার জীবন এবং মর্যাদা ঈশ্বরের হাতে, আমার পিতার সিদ্ধান্তে নয়।” (দ্রৌপদী, মহাভারত)
বকুল এবং তার পিতামাতার সিদ্ধান্ত
মহাভারতে বকুলের চরিত্রটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তার পিতামাতার সিদ্ধান্ত তাকে খুব ছোটবেলা থেকেই অত্যন্ত কঠিন পরিস্থিতির মুখে ফেলে। তার পিতা যখন তাকে রাজ্য পরিচালনার জন্য প্রস্তুত করতে শুরু করেন, বকুলের মধ্যে একধরনের আত্মবিশ্বাস তৈরি হয়। বকুলের জীবন থেকে শিখতে পারি যে, পিতামাতার কঠিন সিদ্ধান্ত অনেক সময় সন্তানকে শক্তিশালী এবং সাহসী করে তোলে।
মহাভারত থেকে উদ্ধৃতি:
“পিতামাতার সিদ্ধান্ত একদিকে যেমন কঠিন হতে পারে, তেমনি তা আমাদের জীবনের শক্তি বাড়াতে সাহায্য করে।” (বকুল, মহাভারত)
উপসংহার
মহাভারত আমাদের জীবনের জন্য এক অনন্ত শিক্ষার আধার। পিতামাতার সিদ্ধান্ত কখনও কখনও আমাদের জীবনে সুখের দিকে, আবার কখনও দুঃখের দিকে নিয়ে যেতে পারে। কিন্তু আমরা যদি মহাভারতের শিক্ষা থেকে কিছু শিখি, তা হলো—সঠিক সিদ্ধান্ত এবং একজন সঠিক পরামর্শদাতার উপস্থিতি আমাদের জীবনের পথ পরিবর্তন করতে পারে। তাই, আপনি কি আপনার জীবনের পথে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছেন? পিতামাতার সিদ্ধান্ত কি আপনার জীবনে সত্যিই প্রভাব ফেলতে পারে, নাকি আপনি নিজের পথেই চলতে চান?