জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হয়। তবে বড়দের সিদ্ধান্তকে মান্য করা এবং সেই সিদ্ধান্তকে প্রশ্ন করার মধ্যে একটি সূক্ষ্ম ভারসাম্য বজায় রাখা কীভাবে সম্ভব? মহাভারত আমাদের এই জটিল প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে।
মহাভারতের দৃষ্টিতে প্রবীণদের সিদ্ধান্ত
মহাভারত বারবার প্রবীণদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের গুরুত্ব তুলে ধরেছে। কিন্তু সেখানে একইসঙ্গে বুদ্ধি ও বিবেকের প্রয়োগের কথাও বলা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, মহাভারতের এক অধ্যায়ে যখন ভীষ্ম পিতামহ দ্যুতক্রীড়ার সময় দ্রৌপদীর অপমান দেখেও নীরব থাকেন, তখন যুধিষ্ঠির নিজেই বুঝতে পারেন যে প্রবীণদের প্রতিটি কাজ শ্রদ্ধার যোগ্য নয়।
একবার ভাবুন, আপনি যখন কোনো বড় সিদ্ধান্ত নেবেন, তখন কী করবেন? আপনি কি কেবল প্রবীণদের কথা শুনবেন, নাকি নিজে বিশ্লেষণ করবেন?
প্রবীণদের সিদ্ধান্তে শ্রদ্ধার কারণ
আমরা কেন প্রবীণদের সিদ্ধান্তকে শ্রদ্ধা করি? কারণ তাঁদের জীবনের অভিজ্ঞতা।
যেমন ভীষ্মের প্রতি পাণ্ডবদের শ্রদ্ধা কখনও কমেনি, কারণ তিনি ছিলেন জ্ঞানের প্রতীক। ভীষ্ম পিতামহ নিজেই বলেছিলেন:
“ধর্মমর্থং চ কামশ্চ সর্বং ধর্মঃ প্রতিষ্ঠিতম্।”
(ধর্মই সবকিছুর ভিত্তি।)
এই মন্ত্র অনুসরণ করে, প্রবীণরা যে কোনো সিদ্ধান্তের আগে ন্যায় ও ধর্মের কথা মাথায় রাখেন। আমাদের উচিত তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা।
তবে প্রশ্ন করাও প্রয়োজনীয়
তবে, মহাভারত আমাদের শেখায় যে প্রশ্ন তোলা খুবই জরুরি। উদাহরণস্বরূপ, অর্জুন যখন ধর্মক্ষেত্রে যুদ্ধ করার বিষয়ে দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন, তখন তিনি শ্রীকৃষ্ণকে প্রশ্ন করেন:
“ধর্মসংমূঢ়চেতাঃ ত্বাং প্রপন্নং।”
(আমার মন যখন ধর্মের পথ নিয়ে বিভ্রান্ত, আমি তোমার শরণাপন্ন।)
শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনের এই প্রশ্নকে অবজ্ঞা করেননি, বরং তাঁর সমস্ত দ্বিধার উত্তর দিয়ে তাঁকে সঠিক পথ দেখিয়েছেন। এর থেকে আমরা শিখি, প্রবীণদের সিদ্ধান্তের বিষয়ে সন্দেহ থাকলে প্রশ্ন করা উচিত।
ভারসাম্য বজায় রাখার উপায়
শ্রদ্ধা দিয়ে শুরু করুন:
প্রবীণদের অভিজ্ঞতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হন। তাদের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনুন। এটি তাদের প্রতি আপনার আস্থার বহিঃপ্রকাশ।
বিবেক ব্যবহার করুন:
যখনই কোনো সিদ্ধান্ত আপনার কাছে সন্দেহজনক মনে হয়, তখন নিজের বিবেকের ওপর ভরসা রাখুন। মহাভারতে বলা হয়েছে:
“উদ্ধরেত আত্মনাআত্মানম নাত্মানমবসাদয়েত।”
(নিজেকে নিজেই উন্নত করুন, নিজেকে কখনও অবমূল্যায়ন করবেন না।)
বিনয়ের সাথে প্রশ্ন তুলুন:
প্রবীণদের কাছে প্রশ্ন তোলা কখনোই অশ্রদ্ধা নয়। তবে, প্রশ্ন করার ধরন হতে হবে নম্র। উদাহরণস্বরূপ, যুধিষ্ঠির যখন ভীষ্ম পিতামহের কাছে প্রশ্ন তুলেছিলেন, তখন তিনি নম্রভাবে বলেছিলেন:
“কী করিলে ধর্ম পালন সম্ভব?”
যুক্তির ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিন:
কেবল আবেগের ওপর নির্ভর না করে, সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে যুক্তি এবং বাস্তবতার ওপর নির্ভর করুন।
শিক্ষার মাধ্যমে নিজেকে সমৃদ্ধ করুন:
আপনার প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে মহাভারতের মতো শাস্ত্র পড়ুন। প্রতিটি চরিত্রের সিদ্ধান্ত থেকে আমরা কিছু না কিছু শিখতে পারি।
মহাভারতের আরও উদাহরণ
- অভিমন্যুর সিদ্ধান্ত:
যদিও অভিমন্যু কৌরবদের চক্রব্যূহ ভাঙার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, কিন্তু প্রবীণদের কাছ থেকে সম্পূর্ণ জ্ঞান না নিয়ে এগিয়ে যাওয়া তাঁর জীবনের জন্য কাল হয়েছিল। - বিদুরের উপদেশ:
বিদুর সবসময় ন্যায়ের পক্ষে কথা বলেছেন, এমনকি প্রবীণদের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে গিয়েও। তিনি বলেছিলেন:
“ধর্মের জন্য যদি নিজের স্বার্থ ত্যাগ করতে হয়, তবে তা করাই উচিত।”
আপনার জীবনের জন্য পরামর্শ
আপনার জীবনের প্রতিটি সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে, আপনি কি প্রবীণদের মতামতকে গুরুত্ব দেন? যদি দেন, তবে তা ভালো। তবে মনে রাখবেন, নিজের বিবেকের কথা শুনুন এবং সন্দেহ থাকলে নম্রভাবে প্রশ্ন তুলুন।
শ্রদ্ধা এবং প্রশ্নের মধ্যে এই ভারসাম্য আমাদের জীবনে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করবে।
এক চিন্তার উত্থান
মহাভারত আমাদের শেখায় যে শ্রদ্ধা এবং প্রশ্ন একে অপরের বিরোধী নয়। বরং, এই দুইয়ের সমন্বয়ে জীবনের প্রতিটি সমস্যার সমাধান সম্ভব। তাই, আপনি যখন আগামীবার প্রবীণদের কোনো সিদ্ধান্ত মানবেন বা প্রশ্ন করবেন, তখন নিজেকে প্রশ্ন করুন:
“আমি কি সত্যিই ধর্মের পথে আছি?”