আমরা প্রায়শই মহাভারতের কাহিনীগুলি থেকে শিক্ষা নিতে চাই, কারণ এর প্রতিটি চরিত্র আমাদের জীবনের বিভিন্ন দিককে প্রতিফলিত করে। ভীষ্ম, যিনি তাঁর প্রতিজ্ঞা, জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতার জন্য কিংবদন্তি, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। আজ আমরা আলোচনা করব, কিভাবে তাঁর জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতা এই মহাযুদ্ধের গতিপথকে প্রভাবিত করেছিল এবং কিভাবে আপনি তাঁর জীবন থেকে প্রেরণা নিয়ে আপনার জীবনে পরিবর্তন আনতে পারেন।
ভীষ্মের প্রতিজ্ঞার মর্মার্থ
আপনারা হয়তো জানেন, ভীষ্মের জীবন পরিচালিত ছিল তাঁর বিখ্যাত প্রতিজ্ঞার মাধ্যমে—তিনি সিংহাসনের জন্য তাঁর অধিকার ত্যাগ করেছিলেন এবং আজীবন ব্রহ্মচর্য পালন করেছিলেন। এই প্রতিজ্ঞা শুধুমাত্র তাঁর চরিত্রের দৃঢ়তাকেই প্রকাশ করে না, এটি কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধেও তাঁর অবস্থানকে সংজ্ঞায়িত করেছিল। ভীষ্ম কৌরব পক্ষের প্রধান সেনাপতি ছিলেন, যদিও তিনি জানতেন যে ধর্মের পথে পাণ্ডবরা। তাঁর এই দ্বন্দ্বময় অবস্থান আমাদের দেখায়, কীভাবে নৈতিকতার চেয়ে প্রতিজ্ঞা কখনও কখনও বড় হয়ে ওঠে। আপনি কি কখনও নিজের জীবনে এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছেন যেখানে আপনাকে আপনার প্রতিজ্ঞা এবং নৈতিকতার মধ্যে সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে? ভীষ্মের কাহিনি সেই পরিস্থিতিতে আপনাকে গভীর চিন্তা করতে সাহায্য করবে।
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের সময় ভীষ্মের ভূমিকা
যুদ্ধের প্রারম্ভে ভীষ্ম ছিলেন দুর্যোধনের প্রধান ভরসা। তাঁর সামরিক জ্ঞান এবং কৌশলগত বুদ্ধিমত্তা কৌরব সেনাকে দৃঢ় অবস্থানে রেখেছিল। উদাহরণস্বরূপ, মহাভারতের শল্যপর্বে বর্ণিত হয়েছে যে, ভীষ্মের নেতৃত্বে প্রথম দশ দিন কৌরবরা পাণ্ডবদের উপর শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রেখেছিল। তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে নিজেকে একজন অপরাজেয় যোদ্ধা হিসাবে প্রমাণ করেছিলেন।
তবে, ভীষ্ম কেবলমাত্র একজন যোদ্ধা ছিলেন না; তিনি একজন দার্শনিক এবং পথপ্রদর্শকও ছিলেন। যুদ্ধের মাঝেও তাঁর পরামর্শ ছিল শিক্ষামূলক। তিনি অর্জুনকে বলেছিলেন, “ধর্মকে কখনোই বিসর্জন দিও না, কারণ ধর্মই জীবনের মূল ভিত্তি।” আপনি যদি নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত গ্রহণে দ্বিধাগ্রস্ত হন, ভীষ্মের এই উক্তি আপনাকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে পারে।
অর্জুনকে পরামর্শ
যুদ্ধের সময় একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হল, যখন ভীষ্ম অর্জুনকে বলেন যে, পিতামহ হিসেবে তিনি তাঁর প্রতি ভালোবাসা অনুভব করেন, তবে যুদ্ধক্ষেত্রে তাঁর কর্তব্যই সর্বোচ্চ। তিনি অর্জুনকে তাঁর ধর্ম (কর্তব্য) পালন করতে বলেন এবং জানান যে, প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও নিজের পথ থেকে বিচ্যুত হওয়া উচিত নয়। মহাভারতের এই দৃশ্য আমাদের শেখায়, ব্যক্তিগত আবেগ এবং সামাজিক কর্তব্যের মধ্যে ভারসাম্য রাখা কতটা জরুরি।
ভীষ্মের পতনের কারণ
আপনি কি জানেন, ভীষ্মের পতনের জন্যও তিনি নিজেই আংশিকভাবে দায়ী ছিলেন? শিখণ্ডীকে তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে হত্যা করতে অস্বীকৃতি জানান, কারণ শিখণ্ডী ছিলেন একজন নারী থেকে পুরুষে রূপান্তরিত। অর্জুন এই সুযোগে শিখণ্ডীকে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করে ভীষ্মকে পরাজিত করেন। এই ঘটনা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, কখনও কখনও নিজের নীতিতে অটল থাকা আমাদের জন্য ক্ষতিকারক হতে পারে।
ভীষ্মের উপদেশ: শান্তিপর্ব
যখন ভীষ্ম শরশয্যায় শায়িত ছিলেন, তখন তিনি যুধিষ্ঠিরকে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে জ্ঞান প্রদান করেন, যা মহাভারতের শান্তিপর্বে বর্ণিত। তাঁর কিছু বিখ্যাত উক্তি হল:
- “যে ব্যক্তি অন্যের মঙ্গলের জন্য কাজ করে, সে কখনোই পরাজিত হয় না।”
- “ধর্ম, অর্থ, কাম এবং মোক্ষ—এই চারটি জীবনের মূল স্তম্ভ। এদের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখাই জীবনের সার্থকতা।”
- “ক্ষমা সবচেয়ে বড় গুণ, যা মানুষকে প্রকৃত শান্তি প্রদান করে।”
আপনার জীবনের প্রতিদিনের সমস্যাগুলি যদি বিশ্লেষণ করেন, তবে আপনি দেখবেন ভীষ্মের এই উপদেশগুলি কতটা প্রাসঙ্গিক।
আপনার জীবনে ভীষ্মের শিক্ষার প্রয়োগ
আমি প্রায়ই ভাবি, আমরা কি ভীষ্মের মতো নৈতিকতার প্রতি এতটা দৃঢ় থাকতে পারব? আপনি যখন নিজের জীবনে সমস্যার সম্মুখীন হন, তখন ভীষ্মের কাহিনীগুলি আপনাকে সঠিক দিশা দেখাতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, আপনি যদি অফিসে কোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় নৈতিকতার বিরুদ্ধে যেতে বাধ্য হন, ভীষ্মের জীবন থেকে অনুপ্রেরণা নিতে পারেন।
শেষ কথা
মহাভারত কেবল একটি মহাকাব্য নয়; এটি জীবনের পাঠশালা। ভীষ্মের জীবন আমাদের শেখায় প্রতিজ্ঞা, নৈতিকতা এবং কর্তব্যের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। আপনি কি ভীষ্মের মতো নিজের জীবনে সঠিক পথ খুঁজে নিতে পারবেন? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আপনার জীবনেও মহাভারতের শিক্ষাকে প্রয়োগ করে দেখুন।
“ধর্ম রক্ষা করবে তোমাকে, যদি তুমি ধর্ম রক্ষা করো।” এই মূলমন্ত্র আমাদের জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে পথপ্রদর্শক হয়ে উঠতে পারে।