ভীষ্মের সবার প্রতি দায়িত্ববোধ তার সম্পর্কগুলোকে কীভাবে প্রভাবিত করেছিল?

যখন আমি মহাভারত পড়ি, তখন ভীষ্ম পিতামহের চরিত্র আমাকে গভীরভাবে ভাবায়। তাঁর জীবন আমাদের জন্য এক প্রেরণা, কারণ তিনি ছিলেন একজন দুর্দান্ত যোদ্ধা, কিন্তু তার থেকে বড় কিছু ছিল—একটি অটল দায়িত্ববোধ। এই দায়িত্ববোধের কারণে তাঁর সম্পর্কগুলোও এক বিশেষ রূপে বিকশিত হয়েছিল। তাঁর জীবন ছিল এক অদ্ভুত সমন্বয়—রাজনীতি, ধর্ম, এবং ব্যক্তিগত অনুভূতির মধ্যে সেতু। আজ, আপনি এবং আমি যদি এই দায়িত্ববোধের মন্ত্র শিখে আমাদের জীবনে প্রয়োগ করতে পারি, তবে তা আমাদের সম্পর্কগুলোকে কীভাবে নতুন আঙ্গিকে উপস্থাপন করবে, তা ভাবতে থাকি।

মহাভারতের নানা স্তরে ভীষ্মের জীবনের গল্প গড়া, তাঁর দায়িত্ববোধের ফলে তাঁর সম্পর্কগুলোরও এক গভীর অর্থ ফুটে উঠেছে। আজকের আলোচনায়, আমরা সেই দায়িত্ববোধের প্রভাব নিয়ে কথা বলব এবং বুঝতে চেষ্টা করব কিভাবে এটা তাঁর সম্পর্কগুলোর ভিতর দিয়ে পরিবর্তিত হয়েছিল।

 পিতার প্রতি দায়িত্ববোধ

প্রথমেই আসা যাক ভীষ্মের পিতার প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতা নিয়ে। ভীষ্মের নামের পিছনে যে ইতিহাস লুকিয়ে আছে, তা আমাদের সবাইকে গভীরভাবে ভাবায়। তিনি ছিলেন মহর্ষি শান্তনুর পুত্র, এবং একদিন যখন তাঁর পিতা প্রেমে পড়ে বসে তাঁর বিবাহের সিদ্ধান্ত নিতে চেয়েছিলেন, তখন ভীষ্মের এক অকল্পনীয় ত্যাগ শোনা যায়। তিনি পিতার সুখের জন্য নিজের ভবিষ্যৎ বিসর্জন দেন, এবং তাঁর চিরকাল পিতা হতে পারে এমন পুত্রের অধিকারও ত্যাগ করেন।

একটি দৃশ্যে পিতার প্রতি তাঁর দায়িত্ববোধের গভীরতা ফুটে ওঠে। পিতার চাহিদা পূরণে তিনি নিজের জীবনের সমস্ত ইচ্ছা এবং অধিকার বিসর্জন দিয়ে ছিলেন। মহাভারতের একটি বিখ্যাত উক্তি মনে পড়ছে, “তাঁর পিতার জন্য নিজেকে নিঃস্ব করে দেওয়াই ছিল ভীষ্মের ধর্ম।”

আপনি কখনো কি নিজের পরিবার বা প্রিয়জনদের জন্য এমন ত্যাগ করেছেন? ভীষ্মের মতো তাঁর দায়িত্ববোধ আমাদেরও কি আমাদের সম্পর্কগুলোকে আরও দৃঢ় করে না?

 নিজের কৃতজ্ঞতা ও দায়বদ্ধতা

ভীষ্মের জীবনে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত হলো, তিনি কখনো তাঁর দায়িত্ব থেকে পিছু হটেননি, যদিও তাঁর জীবন কখনো সুখকর ছিল না। তিনি নিজের দৃষ্টিতে সবসময় দায়িত্ববোধের মধ্যেই জীবন কাটিয়েছেন। বিশেষ করে, তিনি যখন যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন, তখন তিনি নিজেকে এক পবিত্র কৃতজ্ঞতা ও দায়বদ্ধতার অধিকারী হিসেবে দেখেছিলেন। তাঁর কাছে ‘কর্তব্য’ ছিল সবকিছুর ঊর্ধ্বে। তাঁর এমন ত্যাগ, যা মানবিক সম্পর্কগুলোর সীমা অতিক্রম করেছিল, তা সত্যিই অনুপ্রেরণাদায়ী।

এটি এক বড় প্রশ্ন তুলে ধরে: আমরা কি নিজেদের দায়িত্ববোধের মধ্যে সমগ্র পৃথিবীকে দেখতে পারি? আমাদের কি নিজেদের জীবনে ও সম্পর্কগুলোতে এমন ত্যাগের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে?

 শত্রুদের প্রতি ন্যায়বোধ

ভীষ্মের সম্পর্ক শুধুমাত্র আত্মীয় বা বন্ধুদের সঙ্গে সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং তিনি শত্রুদের সঙ্গেও ন্যায়বোধের পরিচয় দিয়েছেন। মহাভারতে এক জায়গায় দেখা যায়, তিনি যুদ্ধের ময়দানে কুরুদের বিরুদ্ধে লড়াই করলেও, কখনো অসদাচরণ করেননি। একবার দ্রোণাচার্য এবং কর্ণের মতো চরিত্রদের সঙ্গে তাঁর যে শ্রদ্ধা ও দায়িত্ববোধ ছিল, তা তাঁকে শত্রুদের প্রতি সম্মান দেখাতে সাহায্য করেছিল। যখন তিনি দ্রোণের প্রতি যুদ্ধের শর্তে সম্মতি দেন, তখন তাঁর এক উক্তি মনে পড়ে যায়—“যুদ্ধের ময়দানে কোন ব্যক্তি যদি শত্রুর প্রতি ন্যায়বোধ বজায় রাখে, তবে সে পুত্রের চেয়েও বড়।”

এখানে আমি বুঝতে পারি, এমন পরিস্থিতি হতে পারে যখন আমাদের শত্রুদের প্রতি শালীনতা এবং সম্মান দেখানো উচিত। আপনি কি কখনো আপনার শত্রুর কাছে এমন নিরপেক্ষতা ও ন্যায়বোধ দেখানোর চেষ্টা করেছেন?

 শিষ্যদের প্রতি দায়িত্ববোধ

ভীষ্ম পিতামহের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ববোধ ছিল তাঁর শিষ্যদের প্রতি। তিনি তাঁর শিষ্যদের মধ্যে একজন গুরু হিসেবে তাঁর জীবনযাপন করতেন এবং তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল ধর্ম এবং ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা। তিনি একবার ধৃতরাষ্ট্রকে বলেছিলেন, “অর্থ বা ক্ষমতা নয়, তোমার পুত্রদের শিক্ষা এবং নৈতিক গুণাবলী সবার থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।” এমন একটি দায়িত্ববোধ তাঁর চরিত্রের মধ্যে ছিল যা শুধুমাত্র রাজনৈতিক নয়, মানবিক এবং আধ্যাত্মিকভাবেও ছিল প্রভাবশালী।

আজকে আমাদের জীবনে যদি আমরা প্রত্যেকটি সম্পর্কের প্রতি এমন দৃষ্টিভঙ্গি অবলম্বন করি, তাহলে কী হবে? আমাদের শিক্ষক, বন্ধু, সহকর্মী, এমনকি আমাদের সন্তানদের সঙ্গে আমরা কীভাবে সম্পর্ক স্থাপন করি?

 স্ব-প্রকাশের প্রতি সীমাবদ্ধতা

ভীষ্মের জীবনও আমাদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা দেয়—নিজের জীবনযাপন কখনোই শুধুমাত্র নিজের জন্য নয়। যদিও তিনি এক মহান যোদ্ধা ছিলেন, তিনি কখনো নিজের অনুভূতিগুলো প্রকাশ করেননি। বিশেষ করে, তাঁর মনে এক গভীর দুঃখ ছিল—তিনি যে সতীশুদ্ধ, চরিত্রবান এবং ন্যায়পরায়ণ জীবনযাপন করেছেন, তবুও নিজের প্রেমিকার কাছে নিজেকে কখনোই গ্রহণ করতে পারেননি। তার মধ্যে যে এক অগাধ আত্মত্যাগ ছিল, তা কখনোই লোকের সামনে আসেনি।

এটি আমাকে ভাবতে বাধ্য করে, আমাদের যদি কিছু মানদণ্ড থাকে যা ব্যক্তিগতভাবে আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, তবে আমরা কি সেগুলোর প্রতি সবসময় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকি? অথবা আমরা কখনো নিজের অনুভূতি ভুলে গিয়ে, দায়িত্বের বোঝা বহন করি?

উপসংহার

ভীষ্ম পিতামহের জীবন এবং তাঁর দায়িত্ববোধের গভীরতা আমাদের সম্পর্কগুলোকে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে। তিনি প্রতিটি মুহূর্তে নিজের কর্তব্য পালনে একাগ্র ছিলেন, কিন্তু সেই কর্তব্যের মাঝে তিনি কখনোই নিজের মানবিকতা হারাননি। তাঁর জীবন আমাদের শেখায়, জীবনের সকল সম্পর্কের মাঝে দায়বদ্ধতা, শ্রদ্ধা, এবং ন্যায়বোধ সবচেয়ে বড় সম্পদ। আমাদের প্রতিদিনের জীবনেও যদি আমরা এই দায়িত্ববোধের আদর্শ গ্রহণ করতে পারি, তবে আমাদের সম্পর্কের মধ্যে খুঁজে পাবো এক নতুন শক্তি এবং গভীরতা।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top