ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা কি হস্তিনাপুরের রাজপরিবারে অশান্তির কারণ ছিল?

ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা কি হস্তিনাপুরের রাজপরিবারে অশান্তির কারণ ছিল?

আপনি কি কখনো ভেবে দেখেছেন, প্রতিজ্ঞার মূল্য কি শুধুই ব্যক্তিগত থাকে? নাকি তার প্রভাব সমাজে এবং অন্যদের জীবনে পড়ে? মহাভারতের অন্যতম প্রধান চরিত্র ভীষ্ম তাঁর জীবনের এক মহান প্রতিজ্ঞার জন্য পরিচিত। কিন্তু সেই প্রতিজ্ঞা কি হস্তিনাপুরের রাজপরিবারে শান্তির বদলে অশান্তি ডেকে এনেছিল? আসুন, এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করার চেষ্টা করি।

ভীষ্মের প্রতিজ্ঞার পটভূমি

ভীষ্ম, যাঁর আসল নাম দেবব্রত, ছিলেন সত্যবতী এবং শন্তনুর সন্তান। শন্তনু যখন সত্যবতীকে বিয়ে করতে চান, তখন সত্যবতীর পিতা একটি শর্ত রাখেন—সত্যবতীর পুত্রই হবেন হস্তিনাপুরের ভবিষ্যৎ রাজা। এটি শুনে দেবব্রত, যিনি নিজেই সিংহাসনের উত্তরাধিকারী ছিলেন, এক কঠিন প্রতিজ্ঞা নেন। তিনি ঘোষণা করেন যে, তিনি কোনোদিন সিংহাসনে বসবেন না এবং আজীবন অবিবাহিত থাকবেন। এই প্রতিজ্ঞার কারণেই তাঁকে ‘ভীষ্ম’ উপাধি দেওয়া হয়, যার অর্থ এমন একজন যিনি ভীষণ কঠোর শপথ গ্রহণ করেছেন।

তবে, তাঁর এই প্রতিজ্ঞা কেবল ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তে সীমাবদ্ধ ছিল না। এর প্রভাব পড়েছিল রাজপরিবারের পরবর্তী প্রতিটি প্রজন্মের উপর।


ভীষ্মের প্রতিজ্ঞার কারণেই কি মহাভারতের সংঘাত?

আপনারা হয়তো জানেন, মহাভারতের কেন্দ্রবিন্দু ছিল কৌরব এবং পাণ্ডবদের মধ্যে ক্ষমতার লড়াই। এই সংঘাতের শেকড় অনেকাংশে ভীষ্মের প্রতিজ্ঞার মধ্যে নিহিত। চলুন কিছু উদাহরণ দিয়ে এটি বোঝার চেষ্টা করি।

১. উত্তরাধিকারের সংকট

ভীষ্মের প্রতিজ্ঞার কারণে, হস্তিনাপুর রাজপরিবারে একটি শূন্যতা সৃষ্টি হয়। সত্যবতীর দুই পুত্র, চিত্রাঙ্গদ এবং বীচিত্রবীর্য, শাসনভার গ্রহণ করলেও, তাঁদের অকালমৃত্যু হস্তিনাপুরকে উত্তরাধিকারহীন করে তোলে। এর ফলে জন্ম হয় এক অনিশ্চয়তার। পাণ্ডু এবং ধৃতরাষ্ট্র, দুই ভাইয়ের মধ্যে সিংহাসন নিয়ে দ্বন্দ্ব শুরু হয়, যা পরবর্তীতে কৌরব-পাণ্ডব সংঘাতের দিকে গড়ায়।

২. অযোগ্য শাসকের উত্থান

ভীষ্ম নিজে সিংহাসনে বসতে অস্বীকার করেন, কিন্তু একজন যোগ্য শাসকের অভাবে ধৃতরাষ্ট্রের মতো অন্ধ এবং দুর্বল শাসক সিংহাসনে বসেন। তাঁর সিদ্ধান্তহীনতা এবং দুর্বল নেতৃত্ব কৌরবদের দুষ্কর্মে সাহস জোগায়। ভীষ্ম যদি রাজা হতেন, তবে হস্তিনাপুরে এই রকম নেতৃত্ব সংকট নাও হতে পারত।

৩. দ্রৌপদীর অপমান

কৌরবদের মধ্যে দুশ্চরিত্রতা এবং অহংকারের অন্যতম বড় উদাহরণ দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ। এই ঘটনার সময় ভীষ্ম উপস্থিত থাকলেও, তিনি কৌরবদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে পারেননি। তাঁর নীরবতার পিছনে কারণ ছিল তাঁর প্রতিজ্ঞা—তাঁর কর্তব্য ছিল সিংহাসনের প্রতি বিশ্বস্ত থাকা। কিন্তু এই নীরবতা আরও বড় সংঘাতের জন্ম দেয়, যা কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ পর্যন্ত পৌঁছায়।

৪. মহাযুদ্ধের অনিবার্যতা

আপনারা জানেন, ভীষ্ম মহাভারতের যুদ্ধক্ষেত্রে কৌরবদের প্রধান সেনাপতি ছিলেন। নিজের প্রতিজ্ঞার প্রতি বিশ্বস্ত থেকে, তিনি পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে বাধ্য হন। যদিও তিনি জানতেন যে পাণ্ডবরা ন্যায়ের পক্ষে, তবুও তিনি তাঁর শপথ ভাঙতে পারেননি। এটি কেবল ব্যক্তিগত নয়, এক নৈতিক সংঘাতের প্রতীকও বটে।


প্রতিজ্ঞার মূল্য: ভাল না খারাপ?

এখন প্রশ্ন আসে, ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা কি একান্তই দোষের? না, বিষয়টি এত সহজ নয়। ভীষ্ম একজন নীতিবান মানুষ ছিলেন, যিনি তাঁর শপথকে জীবনের চেয়ে বড় করে দেখতেন। তাঁর আদর্শবোধ এবং আত্মত্যাগ মহাভারতের নায়কোচিত দিকগুলোর একটি।

তবে, আমি যদি আপনাকে বলি যে প্রতিজ্ঞা কখনো কখনো কঠোর শৃঙ্খল হয়ে দাঁড়ায়? ভীষ্মের ক্ষেত্রে সেটাই ঘটেছিল। তাঁর প্রতিজ্ঞা তাঁকে নৈতিক এবং পারিবারিক দায়িত্বের মধ্যে একটি সীমারেখা টেনে দিয়েছিল। এর ফলস্বরূপ, তাঁর সিদ্ধান্তগুলির মাধ্যমে হস্তিনাপুরের রাজপরিবারে অশান্তি এবং সংঘাতের সৃষ্টি হয়েছিল।


মহাভারতের শিক্ষার আলোকে আপনার জীবনে প্রতিজ্ঞার ভূমিকা

আপনি কি কোনো প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করেছেন যা আপনার বা অন্যদের জীবনে গভীর প্রভাব ফেলেছে? মহাভারত আমাদের শেখায় যে প্রতিজ্ঞা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, তবে তা কখনোই অন্ধ হওয়া উচিত নয়। ভীষ্মের উদাহরণ থেকে আমরা শিখতে পারি যে, প্রতিজ্ঞা যদি বৃহত্তর কল্যাণের পথে বাধা সৃষ্টি করে, তবে তা পুনর্বিবেচনা করা উচিত।

উদাহরণস্বরূপ:

  • আপনি যদি একটি সিদ্ধান্ত নেন যা আপনার পরিবারে অশান্তি সৃষ্টি করছে, তাহলে সেটি পুনর্বিবেচনা করা কি খারাপ হবে?
  • আপনার আদর্শ যদি অন্যদের ক্ষতি করে, তাহলে কি সেটি প্রকৃত আদর্শ হতে পারে?

উপসংহার

মহাভারতের ভীষ্ম আমাদের জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ পাঠ দিয়ে যান—নীতির পথ অবশ্যই অবলম্বন করতে হবে, তবে তা অন্ধভাবে নয়। প্রতিজ্ঞার মধ্যে যদি নমনীয়তা থাকে, তবে তা আমাদের এবং অন্যদের জন্য আরও মঙ্গলজনক হতে পারে।

তাহলে, আপনি কীভাবে প্রতিজ্ঞা বা আদর্শকে আপনার জীবনে ভারসাম্যপূর্ণ রাখবেন? আপনি কি ভীষ্মের মতো কঠোর হতে চান, নাকি নমনীয়তাকে জীবনের অংশ করবেন? মহাভারতের এই অনন্ত প্রশ্ন আমাদের জীবনের পথে দিশা দেখায়।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top