ভীষ্ম কি কৌরব এবং পাণ্ডবদের দ্বারা যথাযথ সম্মান পেয়েছিলেন?

মহাভারত‌‌‌‌‌‌ একটি মহাকাব্য যা আমাদের জীবনের জন্য অসংখ্য শিক্ষা বহন করে। যখনই আমরা ভীষ্মের কথা চিন্তা করি, তখন তাঁর দৃঢ় প্রতিজ্ঞা, সততা এবং নীতির প্রতি আনুগত্য আমাদের মুগ্ধ করে। কিন্তু একটি প্রশ্ন বারবার মাথায় আসে—কৌরব এবং পাণ্ডবদের থেকে তিনি কি সত্যিই যথাযথ সম্মান পেয়েছিলেন?

আমি যখন এই প্রশ্নটি ভাবি, তখন মহাভারতের বিভিন্ন ঘটনার কথা মনে পড়ে। আপনিও যদি মহাভারতের নীতিগুলি আপনার জীবনে প্রয়োগ করতে চান, তবে আসুন আমরা এই বিষয়ে গভীরভাবে চিন্তা করি। ভীষ্ম, যিনি ছিলেন কৌরব ও পাণ্ডবদের পিতামহ, তাঁর প্রতি তাদের ব্যবহার এবং সম্মানের মূল্যায়ন করাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা এবং তার প্রভাব

ভীষ্মের জীবন শুরু থেকেই আত্মত্যাগ এবং নীতির প্রতি নিবেদিত। তাঁর অমর প্রতিজ্ঞা—”আমি সারা জীবনের জন্য বিবাহ না করে হস্তিনাপুরের সিংহাসনের সুরক্ষা করব”—একটি বিরল দৃষ্টান্ত। এই প্রতিজ্ঞার মাধ্যমে তিনি নিজের জীবনকে হস্তিনাপুরের সেবা এবং সুরক্ষার জন্য উৎসর্গ করেছিলেন।

কিন্তু আপনি কি লক্ষ্য করেছেন, এই প্রতিজ্ঞার জন্য তাঁকে কতটা মূল্য দিতে হয়েছে? ধৃতরাষ্ট্র, পাণ্ডু, এবং বিদুরের মতো রাজাদের জন্য তিনি নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। যদিও তাঁর এই আত্মত্যাগের জন্য তাঁকে প্রথম দিকে সম্মান দেওয়া হয়েছিল, পরবর্তী সময়ে কৌরব এবং পাণ্ডবদের মধ্যে রাজনীতির চক্রে তিনি কি যথাযথ সম্মান পেয়েছিলেন?

দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ এবং ভীষ্মের নীরবতা

দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের ঘটনাটি একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ। আপনি কি মনে করেন, এই ঘটনায় ভীষ্মের নীরবতা তাঁর প্রতি অসম্মানের প্রতীক নয়? ভীষ্ম বলেছিলেন, “ধর্ম জটিল। আমি কি করব বুঝতে পারছি না।” অথচ তিনি জানতেন যে দ্রৌপদীর প্রতি অন্যায় হচ্ছে। এই নীরবতা কি কৌরবদের প্রতি তাঁর আনুগত্যের কারণে?

এটি প্রমাণ করে যে কৌরবরা তাঁর জ্ঞান এবং নীতিকে সত্যিকার অর্থে সম্মান করেনি। ভীষ্ম হয়তো রাজপরিবারের প্রতি নিজের দায়িত্ব পালন করছিলেন, কিন্তু তাঁকে একটি এমন অবস্থায় ফেলা হয়েছিল যেখানে তাঁর মর্যাদাকে অবহেলা করা হয়েছে।

যুদ্ধক্ষেত্রে ভীষ্মের প্রতি আচরণ

কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে ভীষ্ম ছিলেন কৌরব পক্ষের সর্বাধিনায়ক। তাঁর বয়স এবং অভিজ্ঞতার প্রতি সম্মান জানিয়ে কৌরবরা তাঁকে এই দায়িত্ব দিয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে, কৌরবদের অনেকেই তাঁর পরামর্শ উপেক্ষা করেছিল।

ভীষ্ম নিজেই বলেছিলেন, “অধর্মের পথে যাত্রা করলে পতন অবশ্যম্ভাবী।” কিন্তু দুর্যোধন তাঁর কথা শোনেনি। যুদ্ধের সময়ও ভীষ্ম উপলব্ধি করেছিলেন যে কৌরবদের মধ্যে একতা নেই এবং তাঁরা তাঁর কৌশল মানতে নারাজ। এই পরিস্থিতি কি ভীষ্মের প্রতি অসম্মানের উদাহরণ নয়?

ভীষ্মের পতনের দিন

আপনি কি জানেন, ভীষ্মের মৃত্যুর সময় পাণ্ডবরা তাঁকে কতটা শ্রদ্ধা করেছিল? অর্জুনের তীরে বিদ্ধ হয়ে ভীষ্ম শরশয্যায় শুয়েছিলেন। তখন পাণ্ডবরা তাঁর কাছ থেকে আশীর্বাদ এবং উপদেশ নিতে এসেছিল। কিন্তু প্রশ্ন হলো, যুদ্ধের আগে পাণ্ডবরা কেন ভীষ্মের প্রতি সঠিক সম্মান প্রদর্শন করেনি?

যুদ্ধের সময় তাঁরা কেবল নিজের লক্ষ্য পূরণে মনোযোগী ছিল। ভীষ্মের শরীরকে বিদ্ধ করার সময় অর্জুন কি একবারও ভেবেছিল যে এটি তাঁর পিতামহ? এই ঘটনা আমাদের শেখায় যে অনেক সময় সম্মান কেবল পরিস্থিতি অনুযায়ী প্রদর্শিত হয়।

মহাভারতের উক্তি এবং ভীষ্মের শিক্ষা

মহাভারতের কিছু উক্তি ভীষ্মের অবস্থান এবং সম্মান নিয়ে গভীর বার্তা দেয়। যেমন:

  • “ধর্মানুবন্ধো হি সুখম।” — ধর্মের পথে চলাই সুখের প্রকৃত উপায়।
  • “অধর্মের ফলে সর্বদা পতন ঘটে।” — ভীষ্মের এই উক্তি দুর্যোধনের প্রতি ছিল।
  • “ন হি ধর্মাত্ প্রিয়তমো।” — ধর্মের চেয়ে বড় কিছু নেই।

এই উক্তিগুলি থেকে বোঝা যায় যে ভীষ্ম সর্বদা ন্যায় এবং ধর্মের পক্ষে ছিলেন। তবে কৌরব এবং পাণ্ডবরা তাঁর এই শিক্ষাগুলিকে পুরোপুরি সম্মান করেনি।

বর্তমান জীবনে ভীষ্মের শিক্ষা

আপনি এবং আমি যদি ভীষ্মের জীবনের দৃষ্টান্ত থেকে শিক্ষা নিতে চাই, তবে আমাদের বুঝতে হবে যে আত্মত্যাগ এবং নীতির প্রতি আনুগত্য জীবনে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তা সত্ত্বেও, আমাদের সচেতন থাকতে হবে যে অন্যরা আমাদের মর্যাদা দেয় কিনা।

ভীষ্ম আমাদের শেখান যে সম্মান দাবি করা যায় না; এটি অর্জন করতে হয়। কিন্তু যদি সেই সম্মান না পাওয়া যায়, তবে নিজেকে প্রশ্ন করা উচিত—আমি কি সঠিক পথেই আছি? আমরা যদি আমাদের জীবনে এই শিক্ষা গ্রহণ করি, তবে আমরা নিশ্চিতভাবে উন্নতি করতে পারব।

শেষ প্রশ্ন

অবশেষে, আমি আপনাকে একটি প্রশ্ন ছেড়ে দিতে চাই—আপনার জীবনে যদি ভীষ্মের মতো আত্মত্যাগ এবং নীতি পালন করতে হয়, তবে আপনি কি নিশ্চিত যে আপনার চারপাশের মানুষ আপনাকে যথাযথ সম্মান দেবে? আর যদি না দেয়, তবে আপনি সেই পরিস্থিতি কীভাবে সামলাবেন?

মহাভারতের শিক্ষা আমাদের জীবনকে আলোকিত করে এবং ভীষ্মের গল্প সেই শিক্ষার অন্যতম প্রধান ভিত্তি। আপনার জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে এটি প্রয়োগ করুন এবং দেখুন কীভাবে আপনি আরও উন্নত হতে পারেন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *