আপনি কি কখনো এমন কোনো সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যা আপনার পুরো জীবন বদলে দিয়েছে? ভীষ্মের প্রতিজ্ঞার কথা ভাবুন। তিনি তাঁর পিতার সুখের জন্য একটি কঠোর প্রতিজ্ঞা নিয়েছিলেন: আজীবন ব্রহ্মচারী থাকার। এই প্রতিজ্ঞা শুধু তাঁর জীবন নয়, পুরো কৌরব বংশের ভবিষ্যৎও গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল।
আমি মনে করি, ভীষ্মের জীবন থেকে আমরা অনেক মূল্যবান শিক্ষা পেতে পারি। তাঁর প্রতিজ্ঞা তাঁকে একজন মহান ব্যক্তিত্বে পরিণত করলেও, এর ফলে তিনি ব্যক্তিগতভাবে যে কষ্ট পেয়েছেন তা অস্বীকার করার উপায় নেই। আসুন, আমরা এই বিষয়ে গভীরভাবে আলোচনা করি।
ভীষ্মের প্রতিজ্ঞার পটভূমি
ভীষ্ম, জন্মসূত্রে দেবব্রত, তাঁর পিতা শান্তনু এবং মাতা গঙ্গার পুত্র। শান্তনু সত্যবতীর প্রেমে পড়লে, সত্যবতীর পিতা শর্ত দিয়েছিলেন যে তাঁর সন্তানেরাই কুরুবংশের উত্তরাধিকারী হবে। দেবব্রত এই শর্ত মেনে নিয়ে ব্রহ্মচর্যের প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করেন। এর ফলে, তিনি ভীষ্ম নামে পরিচিত হন, যার অর্থ “যিনি ভীষণ কঠিন শপথ নিয়েছেন।”
আপনি কি অনুভব করেন যে ভীষ্মের এই সিদ্ধান্ত তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে এক বিশাল শূন্যতা তৈরি করেছিল? মহাভারতে বলা হয়েছে:
“প্রতিজ্ঞা পালন করাই একজন সত্যিকার যোদ্ধার ধর্ম। কিন্তু প্রতিজ্ঞার বোঝা বহন করতে হয় একা।”
ব্যক্তিগত জীবনের শূন্যতা
ভীষ্ম নিজের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য সব ত্যাগ করেছিলেন। তিনি বিয়ে করেননি, সন্তান জন্ম দেননি। তার পরিবর্তে, তিনি কৌরবদের রক্ষক হিসেবে জীবনের সবকিছু উৎসর্গ করেন। কিন্তু এই ত্যাগ কি তাঁকে একা করে দেয়নি?
মহাভারতে আমরা দেখতে পাই, ভীষ্ম কখনোই নিজের কোনো ইচ্ছার কথা প্রকাশ করেননি। তিনি কেবল কৌরব পরিবারের জন্য কাজ করে গেছেন। এমনকি যখন দুর্যোধন ভুল পথে চলতে শুরু করে, ভীষ্ম বাধা দিতে পারেননি। এর ফলে তিনি এক গভীর দুঃখ অনুভব করেছিলেন।
প্রতিজ্ঞার প্রতি অটল থাকা
আপনি কি ভেবে দেখেছেন, এত বড় প্রতিজ্ঞা পালন করতে কতটা মানসিক শক্তি প্রয়োজন? যখন দ্রৌপদীর চীরহরণ হল, ভীষ্ম তা প্রতিরোধ করতে পারলেন না। কারণ তিনি কৌরবদের রক্ষাকর্তা হিসেবে দায়বদ্ধ ছিলেন। এই ঘটনার পর তিনি নিজেই বলেছেন:
“ধর্মের জটিলতা এমন যে, কখনো কখনো সঠিক ও ভুলের মধ্যে পার্থক্য করা কঠিন হয়ে যায়।”
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ
ভীষ্মের জীবনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ। তিনি জানতেন, পাণ্ডবরা ধর্মের পক্ষে। তবুও তিনি কৌরবদের পক্ষে যুদ্ধ করেছিলেন। তাঁর প্রতিজ্ঞার কারণে তিনি নিজের বিবেকের বিরুদ্ধে গিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে নামতে বাধ্য হন।
মহাভারতে উল্লেখ আছে:
“যোদ্ধার ধর্ম তাকে যুদ্ধ করতে বাধ্য করে, কিন্তু তার হৃদয় তাকে বারবার প্রশ্ন করে, এটি কি সঠিক পথ?”
আপনার কি মনে হয় ভীষ্ম এখানে নিজেকে দ্বিধাগ্রস্ত এবং দুঃখিত বোধ করেছিলেন?
প্রতিজ্ঞার মূল্য
ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা তাঁকে মহান করেছিল, কিন্তু তাঁর জীবনও কঠিন করে তুলেছিল। তিনি কখনো নিজের জন্য কিছু চাননি, সবকিছু পরিবারের জন্য উৎসর্গ করেছিলেন। কিন্তু এই অশেষ ত্যাগের মূল্য তাঁকে একাকীত্ব, দুঃখ এবং অপরাধবোধে ভুগতে বাধ্য করেছিল।
আমরা দেখতে পাই, ভীষ্ম শয্যায় শুয়ে মৃত্যুর প্রতীক্ষা করছিলেন। সেই সময় তিনি যুধিষ্ঠিরকে বলেছিলেন:
“যখন তুমি সবার জন্য সবকিছু করবে, তখন নিজের জন্য কিছুই থাকবে না।”
আমরা কী শিখতে পারি?
ভীষ্মের জীবন আমাদের শেখায় যে প্রতিজ্ঞা এবং কর্তব্য পালন করার জন্য অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। কিন্তু কখনো কখনো নিজের সুখও গুরুত্বপূর্ণ। যদি আপনি নিজের জীবনের সব ইচ্ছা ত্যাগ করেন, তবে তা আপনাকে একসময় শূন্যতায় ভরিয়ে তুলতে পারে।
আমাদের উচিত, জীবনের প্রতিটি সিদ্ধান্ত ভালোভাবে চিন্তা করা। মহাভারতের মতো এক মহাকাব্য আমাদের এই গভীর শিক্ষা দেয়।
শেষ কথা
আপনি কি মনে করেন, ভীষ্ম যদি তাঁর প্রতিজ্ঞার জায়গায় সামান্য নমনীয়তা দেখাতেন, তাহলে তাঁর জীবন অন্যরকম হতে পারত? মহাভারত বলে:
“জীবন এক দোলনা, যেখানে ভারসাম্য বজায় রাখাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।”