আপনার জীবনেও নিশ্চয়ই এমন সময় এসেছে, যখন সব কিছু যেন অন্ধকারময় মনে হয়েছে। মনে হয়েছে, কারও বোঝা আপনার পক্ষে সম্ভব নয়। মহাভারতের চরিত্রগুলোও এমন অনেক মানসিক চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে গিয়েছিল। আসুন, তাদের জীবন থেকে শিক্ষা নিই, কিভাবে তারা মানসিক সমস্যার মোকাবিলা করেছে।
অর্জুন: দ্বিধা এবং আতঙ্ক
মহাভারতের যুদ্ধক্ষেত্রে, অর্জুন এক সময় মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েছিল। আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধবের বিরুদ্ধে অস্ত্র তোলার কথা ভেবে তিনি দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। তিনি শ্রীকৃষ্ণের কাছে বলেন,
“গাণ্ডীবম্ স্রংসতে হস্তাৎ ত্বক্ৈব পরিদহ্যতে।”
(গাণ্ডীব ধনুক আমার হাত থেকে পড়ে যাচ্ছে, এবং আমার ত্বক জ্বালা করছে।)
অর্জুনের এই আতঙ্ক, হতাশা এবং দ্বিধা এক ধরনের মানসিক সংকট। শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে সমাধান দেন ভগবদ গীতার মাধ্যমে। তিনি বলেন,
“ক্লৈব্যম্ মা স্ম গমঃ পার্থ।”
(হে পার্থ, এই ক্লৈব্যতা তোমাকে স্পর্শ করুক না।)
গীতার এই উপদেশ অর্জুনকে ভয় এবং দ্বিধা কাটিয়ে ওঠার শক্তি দিয়েছিল। আমাদের জীবনে যখন সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগি, তখন অর্জুনের মতো আমাদেরও একজন পথপ্রদর্শকের প্রয়োজন হয়।
যুধিষ্ঠির: দায়িত্বের ভার
যুধিষ্ঠিরের জীবনে সব সময় দায়িত্বের চাপ ছিল। ধর্মকে অনুসরণ করার তাগিদে তিনি অনেক কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পর, যখন হাজারো সৈন্যের মৃত্যু হয়, তখন তিনি নিজেকে দোষী মনে করেন। তিনি বলেন,
“অধর্মেনৈধত্মানো ধর্মো বহুধা প্রকৃতিহ।”
(ধর্মের পথ কখনও কখনও অজান্তেই অধর্মে পরিণত হয়।)
তবে, যুধিষ্ঠির শিখেছিলেন যে নিজের মানসিক শান্তির জন্য ক্ষমা এবং ধৈর্য অপরিহার্য। তাঁর জীবন আমাদের শেখায় যে দায়িত্বের ভার কিভাবে সঠিকভাবে সামলানো যায়।
দ্রৌপদী: অপমান এবং মানসিক দৃঢ়তা
দ্রৌপদীর চরিত্র মানসিক শক্তির এক অনন্য উদাহরণ। দ্যুতক্রিডা সভায়, যেখানে তাঁকে প্রকাশ্যে অপমান করা হয়, তিনি মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েননি। বরং, তাঁর প্রতিক্রিয়া ছিল দৃঢ় এবং সাহসী। তিনি ঈশ্বরের প্রতি ভরসা রেখে দৃঢ় সংকল্প করেছিলেন।
“ধ্যায়ন্তি পরমেশানম্।”
(তিনি সর্বোচ্চ শ্রীকৃষ্ণের প্রতি ভরসা রেখেছিলেন।)
আমাদের জীবনে অপমান বা কষ্ট আসতেই পারে, কিন্তু দ্রৌপদীর মতো মানসিক দৃঢ়তা আমাদের এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে।
ভীষ্ম: একাকিত্ব এবং ধৈর্য
ভীষ্ম তাঁর জীবনের অধিকাংশ সময় একাকীত্বে কাটিয়েছেন। তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন আজীবন ব্রহ্মচর্য পালনের। নিজের পিতা এবং ভ্রাতাদের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকেই তিনি এমন কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তবে, যুদ্ধক্ষেত্রে শরশয্যায় শায়িত অবস্থায় তিনি বলেন,
“ধর্মস্য তত্ত্বং নিহিতং গুহাযাম।”
(ধর্মের সত্য গভীরে নিহিত থাকে।)
ভীষ্মের জীবন আমাদের শেখায় যে ধৈর্য এবং আত্মনিয়ন্ত্রণই একাকিত্বকে ইতিবাচক শক্তিতে পরিণত করতে পারে।
কর্ণ: আত্মপরিচয়ের খোঁজ
কর্ণ সারাজীবন তাঁর পরিচয় নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন। কৌরবদের প্রতি তার আনুগত্য এবং নিজের ভ্রাতাদের প্রতি প্রীতির মধ্যে সব সময় তিনি দ্বন্দ্ব অনুভব করেছেন। তিনি বলেন,
“শাপে অহং ভ্রাতৃনামন্তিক।”
(আমি আমার ভাইদের প্রতি দোষী।)
তবে, কর্ণ আমাদের শেখায় নিজের অবস্থান মেনে নিয়ে সাহসিকতার সঙ্গে বাঁচার শক্তি। জীবন কখনও কখনও আমাদের এমন পরিস্থিতিতে ফেলে, যেখানে আমাদের নিজস্ব পরিচয় নিয়ে সংগ্রাম করতে হয়। কর্ণের মতো সাহস আমাদেরও থাকতে হবে।
মানসিক সমস্যার সমাধানে মহাভারতের শিক্ষা
মহাভারতের এই চরিত্রগুলোর জীবন আমাদের দেখায়, কিভাবে মানসিক সমস্যা মোকাবিলা করা যায়। তাদের শিক্ষা আমাদের জীবনেও প্রাসঙ্গিক। কিছু মূল শিক্ষা হলো:
- ধর্ম এবং মূল্যবোধে দৃঢ় থাকা।
- কোনও অবস্থায় নিজের আত্মবিশ্বাস হারানো উচিত নয়।
- পরিচয় এবং আত্মসংশোধনের জন্য আত্ম-অন্বেষণ জরুরি।
- সমস্যার মোকাবিলায় ধৈর্য এবং সহনশীলতা।
শেষ কথা
মহাভারতের শিক্ষা আজও আমাদের জীবনে পথপ্রদর্শক। আপনার জীবনে যখন কোনও মানসিক সমস্যার সম্মুখীন হবেন, তখন মহাভারতের চরিত্রগুলোর মতো সাহসী এবং ধৈর্যশীল হয়ে তা মোকাবিলা করুন। শেষ পর্যন্ত আপনি নিজেই বলবেন,
“জীবন এক সংগ্রাম, আর সেই সংগ্রামে জয়ী হওয়াই আমাদের লক্ষ্য।”