মহাভারতের যুদ্ধের নেপথ্যে কি ধর্মীয় উগ্রবাদ কাজ করেছিল?

মহাভারত! একটি মহাকাব্য যা আমাদের জীবন ও সমাজের প্রতিচ্ছবি। আপনি কি কখনও ভেবেছেন, মহাভারতের যুদ্ধ, কুরুক্ষেত্রের সেই বিখ্যাত যুদ্ধের পেছনে কী কারণ লুকিয়ে ছিল? আমার মনে হয়, আমরা এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে দেখতে পাই, ধর্ম, নীতি, এবং ব্যক্তিগত স্বার্থের এক জটিল সংমিশ্রণ। কিন্তু, এই সব কিছুর মূলে কি ধর্মীয় উগ্রবাদ কাজ করেছিল?

আপনারা জানেন, মহাভারতের ঘটনাবলী অত্যন্ত গভীর এবং বহুমাত্রিক। এখানে ধর্ম মানে শুধু ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান নয়, বরং জীবনের নীতি এবং দায়িত্বও বোঝানো হয়েছে। কিন্তু সেই ধর্মই কি কখনও উগ্রতার রূপ নেয়নি?

দ্রৌপদীর অপমান এবং প্রতিশোধের আগুন

যখন কৌরবরা দ্রৌপদীকে অপমান করেছিল, তখন শুধু পাণ্ডবদের নয়, গোটা সভার ধর্মবোধকে চ্যালেঞ্জ জানানো হয়েছিল। দ্রৌপদীর সেই বিখ্যাত প্রশ্ন, “ধর্ম কোথায়?” আজও আমাদের মনে জাগে। উগ্রতার এই সূচনা কি ধর্মের নামে অধর্ম ছিল না? “যেখানে ধর্ম থাকে, সেখানেই বিজয় হয়” — এই কথাটি (ধর্মো রক্ষতি রক্ষিতঃ) শ্রীকৃষ্ণের মুখে শুনেছি আমরা। কিন্তু এখানে ধর্ম রক্ষার পরিবর্তে ব্যক্তিগত অহংকার এবং উগ্রতা মাথাচাড়া দিয়েছিল।

কর্ণের আত্মপরিচয় এবং দ্বন্দ্ব

কর্ণের জীবনও ধর্মের উগ্রতার একটি দৃষ্টান্ত হতে পারে। তিনি সূতপুত্র বলে সমাজের অবহেলার শিকার হয়েছিলেন। দুঃশাসনের মতো কৌরবরা কর্ণকে ব্যবহার করেছিল ধর্মের নামে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তারা কর্ণের প্রতি ন্যায় করেছিল কি? কর্ণ নিজেও একসময় বলেন, “আমার ধর্ম যদি সমাজের চোখে অপরাধ হয়, তাহলে আমি নিজেই অপরাধী।” কর্ণের এই দ্বন্দ্ব আমাদের দেখায়, কিভাবে ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা উগ্রতা তৈরি করতে পারে।

শ্রীকৃষ্ণের গীতা উপদেশ

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের শুরুতেই অর্জুন যখন অস্ত্র ত্যাগ করতে চেয়েছিলেন, তখন শ্রীকৃষ্ণ তাকে গীতার উপদেশ দেন। গীতার একটি বিখ্যাত শ্লোক বলছে:

“ক্লৈব্যম্ মা স্ম গমঃ পার্থ, নৈতত্ত্বয়্য্যুপপদ্যতে।”

(তুমি দুর্বলতা ত্যাগ করো, এটা তোমার পক্ষে শোভন নয়।)

কিন্তু এই উপদেশ কি শুধু ধর্ম রক্ষার জন্য ছিল, নাকি ক্ষমতার জন্যও? অনেক সময় ধর্ম রক্ষার অজুহাতে আমরা অন্যায় কাজকে ন্যায় বলে মানতে বাধ্য হই। এখানে শ্রীকৃষ্ণ যে অধিকার এবং দায়িত্বের কথা বলেছিলেন, তা কি কখনও ধর্মীয় উগ্রতার রূপ নেয়নি?

ভীষ্ম এবং দ্রোণাচার্যের নিরপেক্ষতা

ভীষ্ম এবং দ্রোণাচার্য ছিলেন কৌরবদের পক্ষে, যদিও তারা জানতেন যে কৌরবরা অধর্মের পথে রয়েছে। তাদের এই অবস্থান কি ধর্মের নামে উগ্রতার উদাহরণ নয়? ভীষ্ম নিজে বলেন:

“আমি ধর্ম জানি, কিন্তু আমার প্রতিজ্ঞা আমাকে আটকে রেখেছে।”

এখানে প্রতিজ্ঞা এবং ধর্মের মধ্যে দ্বন্দ্ব স্পষ্ট। এই উগ্র অবস্থানই কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধকে অবশ্যম্ভাবী করে তুলেছিল।

ধর্ম বনাম উগ্রতা: একটি গভীর বিশ্লেষণ

আমার মতে, ধর্ম এবং উগ্রতার মধ্যে পার্থক্য বোঝা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মহাভারতে ধর্ম সবসময় ব্যক্তিগত এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের উপর জোর দিয়েছে। কিন্তু যখন ধর্ম ব্যক্তিগত স্বার্থের হাতিয়ার হয়ে ওঠে, তখন তা উগ্রতার রূপ নেয়। আপনি যদি গভীরভাবে ভাবেন, তাহলে দেখবেন যে এই উগ্রতার কারণেই যুদ্ধ অপরিহার্য হয়ে পড়েছিল।

আপনার এবং আমার জীবনে, মহাভারতের এই শিক্ষা কি প্রাসঙ্গিক নয়? আমরা কি কখনও ধর্মের নামে অন্যের প্রতি অন্যায় করি না? আমাদের কি এই প্রশ্ন তোলা উচিত নয় যে ধর্ম আসলে কী বোঝায়?

শেষ কথা

মহাভারত আমাদের শিখিয়েছে যে ধর্মের পথে চলা সহজ নয়, কিন্তু সেই পথেই সত্য। তাহলে, আপনি কি মনে করেন, আমরা মহাভারতের নীতিগুলি জীবনে প্রয়োগ করতে পারি? ধর্মের নাম নিয়ে যদি কোনো উগ্রতা আমাদের জীবনে আসে, আমরা কি তা প্রতিহত করতে প্রস্তুত? চিন্তা করুন, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের মতো আপনার জীবনেও কি কোনো যুদ্ধ চলছে? সেই যুদ্ধে আপনি কি ধর্মের পথে আছেন?

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top