মহাভারতে কৌরব ও পাণ্ডবদের দ্বন্দ্ব কি রাজনৈতিক উত্তেজনার প্রতিফলন?

মহাভারতের কাহিনী শুনলে মনে হয় যেন হাজার বছরের পুরোনো ভারতের রাজনীতি, দ্বন্দ্ব আর জীবনদর্শনের এক জীবন্ত ছবি। আমি যখন কৌরব আর পাণ্ডবদের সংঘর্ষের দিকে তাকাই, তখন এটা স্পষ্ট হয় যে এ শুধু দুই পরিবারের যুদ্ধ নয়। এর মধ্যে লুকিয়ে আছে সামাজিক নীতি, ব্যক্তিগত লোভ আর রাজনৈতিক কৌশলের এক অসামান্য প্রতিফলন।

কৌরব ও পাণ্ডবদের দ্বন্দ্ব: রাজনীতির সূচনা

আপনি কি লক্ষ্য করেছেন, কৌরবদের শাসন পদ্ধতি কতটা শক্তপোক্ত, কিন্তু নীতির অভাবে তা ধ্বংস হয়ে গেল? ধৃতরাষ্ট্র, একজন অন্ধ রাজা, শাসনকাজে ভরসা করেছিলেন দুর্যোধনের মতো এক লোভী ব্যক্তির ওপর। আর পাণ্ডবরা? তাদের নেতৃত্ব ছিল ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের হাতে, যিনি ধর্মের পথে চলার জন্য সবসময় প্রস্তুত ছিলেন।

এই দ্বন্দ্বের মূলে ছিল ক্ষমতার লোভ। দুর্যোধনের কথা ভাবুন, যিনি ভীষণভাবে হিংসায় জ্বলে উঠেছিলেন। তিনি বলেছিলেন:
“না কাঞ্চনা প্রিয়ং কৃত্যং, ন চ প্রিয়তরং মম।”
(মহাভারত, উদ্যোগ পর্ব)
এর অর্থ, “আমার জন্য কেবল আমার লাভই গুরুত্বপূর্ণ, অন্য কিছুর কোনো মূল্য নেই।”

রাজনৈতিক উত্তেজনার উদাহরণ

  •  বৈষ্ণমত সভায় ভাগাভাগি:
    যুধিষ্ঠির যখন ইন্দ্রপ্রস্থ রাজ্যের অধিকার পেলেন, সেটা দুর্যোধনের কাছে অপমানজনক মনে হলো। সেই রাজ্যভাগ আসলে রাজনৈতিক সমঝোতার একটা প্রতীক ছিল। কিন্তু দুর্যোধনের ঈর্ষা এটিকে আরও বড় সংঘর্ষে পরিণত করেছিল।
  •  দ্রৌপদীর অপমান:
    রাজসভায় দ্রৌপদীকে অপমান করা, কেবল একজন নারীকে অপমান করা নয়। এটা ছিল কৌরবদের রাজনৈতিক শক্তি প্রদর্শনের একটা প্রচেষ্টা। দুর্যোধন এবং কর্ণ মিলে যেভাবে দ্রৌপদীকে অপমান করেছিলেন, তা সমাজে নীতির সংকটকেই তুলে ধরেছিল। এখানে দ্রৌপদীর প্রশ্ন ছিল:
    “কিঙ্ ধৃতরাষ্ট্রস্য রাজ্যে ধর্মোsস্তি?”
    (মহাভারত, সভা পর্ব)
    এর মানে, “ধৃতরাষ্ট্রের রাজ্যে কি কোনো ধর্ম আছে?”
  •  কৃষ্ণের শান্তি প্রচেষ্টা:
    যখন কৃষ্ণ কৌরবদের কাছে শান্তি প্রস্তাব নিয়ে গেলেন, সেটাও ছিল এক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক পদক্ষেপ। কৃষ্ণ বলেছিলেন:
    “যে রাজা সত্য ও ধর্মের পথ ধরে চলে, তিনিই প্রকৃত রাজা।”
    কিন্তু দুর্যোধন সেই প্রস্তাবও প্রত্যাখ্যান করেছিল। এতে বোঝা যায়, লোভ যখন মনকে আচ্ছন্ন করে, তখন রাজনৈতিক শান্তি সম্ভব নয়।

জীবনে মহাভারতের শিক্ষা কীভাবে কাজে লাগবে?

আপনি যদি মহাভারতের দিকে ভালো করে তাকান, তবে দেখবেন, প্রতিটি চরিত্র আমাদের জীবনের বাস্তব শিক্ষা দেয়। ধরুন, যুধিষ্ঠিরের কথা। তার ভুল সিদ্ধান্ত এবং জুয়া খেলার আসক্তি আমাদের শেখায় যে জীবনে কোনো পরিস্থিতিতে মূল্যবোধের সাথে আপস করা উচিত নয়।

অন্যদিকে, ভীষ্মের চরিত্রও আমাদের গভীর শিক্ষা দেয়। যদিও তিনি ধর্মের জন্য জীবন উৎসর্গ করেছিলেন, তিনি একাধিকবার কৌরবদের ভুল নীতির বিরুদ্ধে দাঁড়াতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। তার বিখ্যাত উক্তি ছিল:
“যে ধর্ম ছেড়ে অন্যায়কে সমর্থন করে, তার পরিণাম সর্বদা ধ্বংস।”

আপনাদের জন্য মহাভারতের বার্তা

আপনার জীবনে কি কখনো এমন পরিস্থিতি এসেছে, যেখানে আপনাকে ন্যায়ের পথে লড়াই করতে হয়েছে? মহাভারতের শিক্ষা আপনাকে সাহস দিতে পারে। কৃষ্ণ যখন অর্জুনকে বলেছিলেন:
“কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন।”
এর মানে, “তোমার কর্তব্য কাজ করা, ফলের চিন্তা নয়।”
এই উপদেশ আজও আমাদের জীবনে পথ দেখায়। আমরা যদি প্রতিদিন আমাদের কাজটুকু ঠিকমতো করি, তবে জীবনের সংঘর্ষেও জয়ী হতে পারি।

শেষ কথা

মহাভারতের কাহিনী কি সত্যিই আমাদের বর্তমান জীবনের রাজনীতির সঙ্গে মিল খুঁজে পায়? হয়তো আপনি নিজেও এর উত্তর জানেন। আমাদের প্রতিদিনের জীবনে মহাভারতের শিক্ষাকে কতটা প্রয়োগ করতে পারছি, সেটাই বিচার্য।

তাহলে, আপনি কী ভাবেন? মহাভারতের শিক্ষা আজকের সমাজের জন্য কতটা প্রাসঙ্গিক?

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top