মহাভারতে জ্ঞান এবং অহংকারের মধ্যে ভারসাম্য কীভাবে প্রদর্শিত হয়েছে?

আমরা প্রতিদিন আমাদের জীবনে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু কখনও কখনও, জ্ঞান এবং অহংকারের মধ্যে একটি সূক্ষ্ম সীমা থাকে যা আমাদের বিভ্রান্ত করে। মহাভারত, আমাদের এই জীবনযাত্রায় দিশা দেখায়, যেখানে জ্ঞান এবং অহংকারের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আজ আমি তোমাকে মহাভারতের কিছু শিক্ষা ও উদাহরণ দিয়ে দেখাব, কীভাবে তুমি এই ভারসাম্য বজায় রাখতে পারো।

জ্ঞান এবং অহংকারের সংজ্ঞা

জ্ঞান হলো সত্যের সন্ধান, জীবনের গভীরতর বোঝাপড়া। অন্যদিকে, অহংকার হলো সেই জ্ঞানকে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা। মহাভারতে আমরা দেখতে পাই, কেবলমাত্র জ্ঞান অর্জন করলেই চলবে না, সেই জ্ঞানকে সঠিকভাবে ব্যবহার করাই প্রকৃত বুদ্ধিমত্তার লক্ষণ।

অর্জুনের নম্রতা বনাম কার্ণের অহংকার

অর্জুন এবং কার্ণের মধ্যে এক বিশাল পার্থক্য হলো তাদের জ্ঞান এবং ব্যবহার। অর্জুন ছিলেন দ্রোণাচার্যের শিষ্য এবং কুরুক্ষেত্রের অন্যতম শ্রেষ্ঠ তীরন্দাজ। কিন্তু তার জ্ঞান তাকে কখনো অহংকারী করেনি। তিনি সর্বদা শ্রীকৃষ্ণের উপদেশ গ্রহণ করতেন এবং নিজের সীমাবদ্ধতা স্বীকার করতেন। যেমন, শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলেন:

“ন হি জ্ঞানেন সদৃশং পবিত্রমিহ বিদ্যতে।”
(ভগবদ্গীতা ৪.৩৮)

এই শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বোঝাচ্ছেন যে জ্ঞান হলো পৃথিবীর সবচেয়ে পবিত্র জিনিস, কিন্তু তা অর্জন করার জন্য নম্রতা প্রয়োজন। অপরদিকে, কার্ণের কাছে তার দক্ষতা ছিল এক অহংকারের বিষয়। তিনি নিজের শক্তি এবং ক্ষমতা নিয়ে এতটাই গর্বিত ছিলেন যে, কখনো নিজের ভুল স্বীকার করতে পারেননি। এই অহংকারই তাকে দুঃখজনক পরিণতির দিকে ঠেলে দেয়।

যুধিষ্ঠিরের সত্যনিষ্ঠা বনাম দুর্যোধনের অহমিকা

যুধিষ্ঠিরকে আমরা সবাই সত্যনিষ্ঠ এবং ন্যায়পরায়ণ রাজা হিসেবে জানি। তিনি জ্ঞানকে সর্বদা নম্রতার সঙ্গে ব্যবহার করেছেন। তিনি নিজেকে কখনো অন্যদের উপরে রাখার চেষ্টা করেননি। কিন্তু দুর্যোধন তার গৌরব এবং অহংকারের জন্য নিজের ধ্বংস ডেকে এনেছেন।

যেমন, শ্রীকৃষ্ণ দুর্যোধনকে বারবার বোঝানোর চেষ্টা করেছেন যে:

“অহংকারো ভিনাশায়।”
(অহংকার সর্বদা ধ্বংস ডেকে আনে।)

কিন্তু দুর্যোধন নিজের অহংকারে মত্ত থাকায় নিজের পরিবার এবং সাম্রাজ্যের ধ্বংস ডেকে এনেছে। এখান থেকে আমরা শিখি, জ্ঞান যদি অহংকারের রূপ নেয়, তবে তা সর্বনাশ ডেকে আনে।

বিদুরের প্রজ্ঞা

মহাভারতের আরেকটি চমৎকার চরিত্র হলো বিদুর। তিনি জ্ঞানী এবং ন্যায়পরায়ণ ছিলেন। তিনি কখনো ক্ষমতার মোহে পড়েননি। বিদুর সর্বদা রাজাদের সঠিক পথ দেখানোর চেষ্টা করেছেন। তিনি কৌরব রাজপরিবারকে বারবার সতর্ক করেছেন:

“জ্ঞানম্ অমৃতং শুদ্ধম্।”
(জ্ঞান হলো অমৃতের মতো পবিত্র।)

তবে তার কথা শোনা হয়নি। কৌরবদের অহংকার তাদের পাপ ও ধ্বংসের কারণ হয়েছিল। বিদুরের চরিত্র আমাদের শেখায় যে প্রকৃত জ্ঞানী ব্যক্তি কখনো অহংকারী হয় না।

শ্রীকৃষ্ণের শিক্ষা

শ্রীকৃষ্ণের জীবন নিজেই জ্ঞান এবং নম্রতার নিদর্শন। তিনি কখনো অহংকার করেননি, যদিও তিনি সর্বশক্তিমান। তিনি অর্জুনকে ভগবদ্গীতার মাধ্যমে যে জ্ঞান দেন, তা আজও আমাদের জন্য পথপ্রদর্শক। তিনি বলেন:

“কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন।”
(তোমার কর্ম করার অধিকার আছে, কিন্তু তার ফলের আশা করা তোমার অধিকার নয়।)

এই শিক্ষার মর্ম হলো, তুমি যদি জ্ঞানী হও, তবে তা অহংকার ছাড়াই কাজে প্রয়োগ করো। নিজের কৃতিত্ব নিয়ে গর্ব না করে, কাজের প্রতি মনোনিবেশ করো।

আমার এবং তোমার জীবনে প্রভাব

তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ, মহাভারতের এই গল্পগুলো আমাদের জীবনের জন্য কতটা প্রাসঙ্গিক। কখনো কখনো আমরা আমাদের জ্ঞান বা ক্ষমতা নিয়ে গর্ব অনুভব করি। কিন্তু এই অহংকার আমাদের সম্পর্ক নষ্ট করতে পারে এবং আমাদের পথভ্রষ্ট করতে পারে।

আমি যখনই নিজেকে অহংকারী মনে করি, তখন মহাভারতের এই শিক্ষা আমাকে সতর্ক করে। তোমার জীবনেও এই শিক্ষা প্রয়োগ করতে পারো। জ্ঞানকে অহংকারে রূপান্তরিত না করে নম্রতার সঙ্গে ব্যবহার করো।

উপসংহার

মহাভারত আমাদের শেখায়, জ্ঞান হলো আলো, আর অহংকার হলো অন্ধকার। তুমি যদি এই আলোকে সঠিকভাবে ব্যবহার করো, তবে তোমার জীবন উন্নতির পথে এগিয়ে যাবে। তবে যদি তুমি এই আলোকে অহংকারের অন্ধকারে ঢেকে দাও, তবে তা তোমার পতনের কারণ হবে।

তাহলে, তুমি কি তোমার জীবনে জ্ঞান এবং অহংকারের মধ্যে এই ভারসাম্য বজায় রাখতে প্রস্তুত? মহাভারতের শিক্ষা গ্রহণ করে তুমি কি নিজের জীবনে সত্যিকারের উন্নতি আনতে চাও? নিজের কাছে এই প্রশ্ন করো, কারণ উত্তরটিই তোমার ভবিষ্যৎ গড়ে তুলবে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top