মহাভারতে ধর্মকে কীভাবে যুদ্ধের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে?

মহাভারত, পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ মহাকাব্য, আমাদের সামনে তুলে ধরে মানবজীবনের নানান জটিলতা, দ্বিধা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের নীতি। এই মহাকাব্যের প্রতিটি অধ্যায়ে আমরা ধর্ম এবং অধর্মের লড়াই দেখি। কিন্তু এই লড়াই কি শুধুই ন্যায় আর অন্যায়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ? না। মহাভারতে ধর্মকে কেবল একটি নীতিগত ধারণা হিসেবে নয়, বরং যুদ্ধের হাতিয়ার হিসেবেও ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। আজ আমরা এই প্রশ্নের গভীরে যাব এবং আপনাকে এই বিষয়টি উপলব্ধি করানোর চেষ্টা করব।

ধর্মের সংজ্ঞা এবং যুদ্ধের প্রেক্ষাপট

আপনার এবং আমার মতো মানুষদের জন্য ধর্ম মানে ন্যায়, সত্য এবং কর্তব্য পালন। কিন্তু মহাভারতে, ধর্ম ছিল একটি চলমান ধারণা। কখনো এটি শাসকের কর্তব্য, কখনো এটি ভ্রাতৃত্বের প্রতীক, আবার কখনো এটি নীতিগত পন্থা হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। ধর্ম কীভাবে অস্ত্র হয়ে উঠল, তা বোঝার জন্য আমাদের যুদ্ধে যাওয়ার প্রেক্ষাপটটি বুঝতে হবে।

কৃষ্ণের ধর্মবাণী এবং কৌরবদের বিরুদ্ধে পাণ্ডবদের মনোভাব

যুদ্ধ শুরুর আগে, অর্জুন যখন যুদ্ধক্ষেত্রে নিজস্ব আত্মীয়-স্বজনের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরতে দ্বিধান্বিত হয়ে পড়ে, তখন কৃষ্ণ তাঁকে গীতার মন্ত্র দিয়ে ধর্মের প্রকৃত অর্থ বোঝান। তিনি বলেন:
“ক্লৈব্যং মা স্ম গমঃ পার্থ, নৈতত্ত্বয়্যুপপদ্যতে। ক্ষুদ্রং হৃদয়দৌর্বল্যং ত্যক্ত্বোত্তিষ্ঠ পরন্তপ।”
অর্থাৎ, “হে পার্থ, কাপুরুষতা তোমার কাছে মানানসই নয়। দুর্বলতাকে পরিত্যাগ কর এবং যুদ্ধের জন্য উঠে দাঁড়াও।”

এই বক্তব্যে কৃষ্ণ স্পষ্ট করে দেন যে ধর্ম কখনোই ব্যক্তিগত সম্পর্কের উপর নির্ভর করে না। এটি সর্বদা বৃহত্তর কল্যাণের জন্য। অর্জুনের এই উপলব্ধি তাঁকে যুদ্ধে যোগ দিতে এবং ধর্মের রক্ষার জন্য লড়াই করতে উদ্বুদ্ধ করে।

ভীষ্ম এবং দ্রোণকে ধর্মের নামে পরাজিত করা

আপনার মনে প্রশ্ন আসতে পারে, ধর্মের কথা বলে কীভাবে এমন মহান চরিত্রদের পরাজিত করা সম্ভব হয়েছিল? ভীষ্ম, যিনি কৌরবদের পক্ষ থেকে যুদ্ধ করেছিলেন, তাঁকে পরাজিত করতে শিখন্ডীকে ব্যবহার করা হয়। শিখন্ডী ছিলেন ভীষ্মের কাছে এক অযোগ্য প্রতিপক্ষ, কারণ ভীষ্ম প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে তিনি কোনো নারীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবেন না। পাণ্ডবরা এই নৈতিক দুর্বলতাকে ব্যবহার করে ভীষ্মকে পরাজিত করেন।

আবার, দ্রোণাচার্যের ক্ষেত্রে, তাঁর ধর্মনিষ্ঠা এবং পুত্রপ্রেমই তাঁর দুর্বলতা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। যখন দ্রোণ শুনলেন যে তাঁর পুত্র অশ্বত্থামা মারা গেছেন, তিনি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। সেই মুহূর্তে ধৃষ্টদ্যুম্ন তাঁকে হত্যা করেন। এই ঘটনাগুলি প্রমাণ করে যে ধর্ম শুধু যুদ্ধক্ষেত্রে নৈতিকতা নয়, বরং কৌশল হিসেবেও ব্যবহৃত হয়েছিল।

কর্ণ এবং তাঁর ধর্মদর্শন

কর্ণের জীবন একটি ট্র্যাজিক মহাকাব্য। তিনি ছিলেন একজন মহান যোদ্ধা, কিন্তু কৌরবদের প্রতি তাঁর আনুগত্য তাঁকে বারবার ধর্মের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়। যুদ্ধে কর্ণ যখন অর্জুনের বিরুদ্ধে লড়ছিলেন, তখন তাঁর রথের চাকা মাটিতে আটকে যায়। কর্ণ তখন অর্জুনকে অনুরোধ করেন যুদ্ধ থামানোর জন্য, কারণ ধর্ম অনুযায়ী, অসুবিধায় পড়া যোদ্ধার উপর আক্রমণ করা উচিত নয়। কিন্তু কৃষ্ণ তখন অর্জুনকে স্মরণ করিয়ে দেন কর্ণের সেই মুহূর্তের কথা, যখন দ্রৌপদীকে অপমান করা হয়েছিল এবং কর্ণ তা নীরবে সমর্থন করেছিলেন। কৃষ্ণ বলেন:
“অধর্মে ধর্মবুদ্ধিঃ সংলগ্ন।”
অর্থাৎ, অধর্ম যখন ধর্মের ছদ্মবেশ ধারণ করে, তখন ধর্মের সঠিক অর্থ বোঝা কঠিন হয়ে যায়।

এই যুক্তি শুনে অর্জুন কর্ণকে হত্যা করেন। এটি আমাদের দেখায় যে যুদ্ধের সময় ধর্ম কেবল ন্যায় বা অন্যায়ের বিচার নয়, বরং কৌশল এবং সুযোগের প্রতীক হয়ে ওঠে।

যুধিষ্ঠিরের ধর্মপালন এবং মিথ্যা বলা

আপনি কি জানেন, যুধিষ্ঠির, যিনি ধর্মের প্রতীক হিসেবে পরিচিত, তিনিও যুদ্ধের সময় মিথ্যা বলেছিলেন? দ্রোণাচার্যের মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য কৃষ্ণ যুধিষ্ঠিরকে বলেন, তিনি যেন বলেন “অশ্বত্থামা হত, নর বা কুঞ্জর।” যদিও কথাটি সত্য ছিল, কারণ একটি হাতি যার নাম অশ্বত্থামা মারা গিয়েছিল, তবে দ্রোণের পুত্র অশ্বত্থামার কথা বোঝানোর জন্য এটি বলা হয়েছিল। যুধিষ্ঠিরের এই কথায় দ্রোণ তাঁর অস্ত্র সমর্পণ করেন। এটি প্রমাণ করে যে ধর্ম কখনো কখনো প্রয়োজন অনুযায়ী বদলে যায়।

ধর্মের প্রকৃত রূপ

মহাভারত আমাদের শেখায় যে ধর্ম কোনো একমুখী সত্য নয়। এটি সময়, পরিস্থিতি এবং প্রয়োজন অনুযায়ী পরিবর্তিত হয়। আপনি যদি মহাভারতের নীতিগুলি নিজের জীবনে প্রয়োগ করতে চান, তবে আপনাকে বুঝতে হবে যে ধর্ম মানে শুধুই সাদা-কালো নয়; এটি ধূসর অঞ্চলে বিচরণ করে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top