মহাভারতে প্রবীণদের প্রতি অসম্মান কোন কোন ক্ষেত্রে সংঘটিত হয়েছে?

মহাভারত, আমাদের জীবনের দিশারী গ্রন্থ, একটি জটিল সামাজিক বাস্তবতার আয়না। এখানে আপনি এমন অনেক গল্প পাবেন যেখানে প্রবীণদের প্রতি অসম্মান দেখানো হয়েছে, এবং সেই ভুলের কারণে সমাজে বিপর্যয় ঘটেছে। আপনি কি জানেন, মহাভারতের এই ঘটনাগুলো আমাদের জীবনে কিভাবে প্রতিফলিত হয়? আজ আমরা আলোচনা করব সেই সব উদাহরণ নিয়ে, যাতে আপনি আপনার জীবনে মহাভারতের শিক্ষাগুলো প্রয়োগ করতে পারেন।

 পিতামহ ভীষ্মের প্রতি অসম্মান

ভীষ্ম, কৌরব ও পাণ্ডবদের অভিভাবক, সর্বদা নিজের কর্তব্যপালনে অবিচল ছিলেন। কিন্তু কৌরবদের তরফ থেকে তাঁকে যে অসম্মানের মুখোমুখি হতে হয়েছিল, তা আমাদের জন্য বড় শিক্ষা। যুদ্ধক্ষেত্রে কৌরবরা ভীষ্মের মতামত প্রায়শই অবহেলা করত। দুর্যোধন বিশেষত পিতামহের পরামর্শ উপেক্ষা করত এবং তার অহংকারের কারণে এই ভুল করত। ভীষ্ম নিজেই একবার বলেছিলেন:

“ধর্মের পথ ছেড়ে যারা চলে, তারা নিজেই নিজের ধ্বংস ডেকে আনে।”

এই ঘটনার ফলে আমরা শিখি, প্রবীণদের অভিজ্ঞতা এবং পরামর্শকে অবহেলা করলে সমাজের উপর কী বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে।

 দ্রোণাচার্যের প্রতি কৌরবদের বিশ্বাসঘাতকতা

দ্রোণাচার্য ছিলেন একজন মহাপ্রতিভাশালী গুরু, কিন্তু কৌরবরা তাঁর প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করেনি। বিশেষত, দুর্যোধন ও তাঁর অনুচররা যুদ্ধের সময় গুরু দ্রোণের বুদ্ধি ও সামরিক পরিকল্পনাকে পূর্ণ সমর্থন দেয়নি। দ্রোণাচার্যের পুত্র আশ্বত্থামার মৃত্যুর ভুয়া সংবাদ ছড়িয়ে তাঁকে মানসিকভাবে দুর্বল করা হয়েছিল। এই ঘটনার পেছনে যে অসততা ছিল, তা আমাদের বলে:

“সত্যকে যারা উপেক্ষা করে, তাদের পথ সর্বদা অন্ধকারময়।”

আপনার জীবনে কি কখনো আপনি প্রবীণদের প্রতি এমন কোনো আচরণ করেছেন, যা পরে আপনার ক্ষতির কারণ হয়েছে?

 ধৃতরাষ্ট্রের প্রতি দুর্যোধনের দুর্ব্যবহার

ধৃতরাষ্ট্র, কৌরবদের পিতা এবং হস্তিনাপুরের রাজা, তাঁর অন্ধত্বের কারণে দুর্বল ছিলেন। দুর্যোধন এই দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে বহুবার তাঁর পিতার প্রতি অসম্মান প্রদর্শন করেছিল। তিনি পিতার মতামত উপেক্ষা করতেন এবং নিজের ইচ্ছামতো সিদ্ধান্ত নিতেন। ধৃতরাষ্ট্র একবার দুর্যোধনকে বলেছিলেন:

“অহংকার মানুষকে অন্ধ করে দেয়। তুমি যদি এই পথে চলতে থাক, তাহলে ধ্বংস অবশ্যম্ভাবী।”

এই ঘটনাটি আমাদের শিক্ষা দেয় যে, পরিবারের প্রবীণ সদস্যদের প্রতি অসম্মান ভবিষ্যতে বড় বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।

 বিদুরের জ্ঞানকে অবমূল্যায়ন

বিদুর, যিনি ছিলেন ধৃতরাষ্ট্রের উপদেষ্টা এবং কৌরব ও পাণ্ডবদের কাকু, তাঁর জ্ঞান এবং নৈতিকতার জন্য বিখ্যাত ছিলেন। কিন্তু দুর্যোধন এবং তাঁর অনুচররা বিদুরের কথা কখনো গুরুত্ব দিয়ে শোনেনি। বিদুর একবার দুর্যোধনকে সতর্ক করে বলেছিলেন:

“ধর্মের পথ থেকে সরে গেলে, তুমি নিজের জীবন এবং সাম্রাজ্য দুটোই হারাবে।”

দুর্যোধন বিদুরের এই সতর্কবাণী অবহেলা করেছিল এবং তার পরিণতি আমরা সকলেই জানি। আপনার জীবনে কখনো কি এমন হয়েছে, যখন আপনি প্রবীণদের পরামর্শ উপেক্ষা করেছেন এবং পরে তার জন্য অনুশোচনা করেছেন?

 যুধিষ্ঠিরের মায়ামোহ

যুধিষ্ঠির, পাণ্ডবদের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা এবং ধর্মের প্রতীক, একবার স্বর্গারোহণের পথে প্রবীণদের অবহেলা করেছিলেন। যখন কুন্তী ও মাদ্রী তাঁকে প্রবীণদের যত্ন নিতে বলেছিলেন, তখন তিনি রাজ্য শাসনে মগ্ন হয়ে এই দায়িত্বকে অবহেলা করেছিলেন। এই ঘটনা দেখায় যে, যুধিষ্ঠিরের মত ধর্মপ্রাণ ব্যক্তিও প্রবীণদের প্রতি তার কর্তব্য ভুলে যেতে পারেন। পরে, তিনি নিজেই উপলব্ধি করেছিলেন:

“জীবনের প্রতিটি ধাপেই প্রবীণদের সম্মান করা উচিত, তা না হলে আমাদের চরিত্র পূর্ণতা পায় না।”

উপসংহার

মহাভারতের এই উদাহরণগুলো আমাদের শেখায় যে, প্রবীণদের অসম্মান করা মানে আমাদের নিজের জীবনের মূল নীতিগুলোকেই অবহেলা করা। প্রবীণরা তাঁদের অভিজ্ঞতা দিয়ে আমাদের পথ দেখান, আর তাঁদের প্রতি অসম্মান আমাদের নিজেদের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

আপনি যদি মহাভারতের এই শিক্ষাগুলো আপনার জীবনে প্রয়োগ করেন, তাহলে আপনার জীবন আরও সার্থক হতে পারে। তাই, পরের বার যখন আপনি কোনো প্রবীণ ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলবেন, তাঁদের অভিজ্ঞতা এবং পরামর্শকে গুরুত্ব দিন।

“মহাভারত শুধু যুদ্ধের কাহিনী নয়, এটি জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রের জন্য একটি আয়না। আপনি কি এই আয়নায় নিজেকে দেখতে প্রস্তুত?”

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top