মহাভারতে সন্তানের প্রতি পিতামাতার দ্বায়িত্বের ব্যর্থতা কোথায় দেখা যায়?

মহাভারতে সন্তানের প্রতি পিতামাতার দ্বায়িত্বের ব্যর্থতা কোথায় দেখা যায়?

মহাভারত শুধু একটি মহাকাব্য নয়, এটি জীবনের আয়না। এই আয়নায় আপনি নিজের জীবনের প্রতিচ্ছবি দেখতে পাবেন—আপনার সম্পর্ক, কর্তব্য, ভুল এবং শিক্ষা। আজ আমি আপনার সাথে এমন এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করব, যা মহাভারতে বারবার ফুটে উঠেছে: পিতামাতার সন্তানের প্রতি দ্বায়িত্ব, এবং তার ব্যর্থতা।

আপনার মনে হতে পারে, “পিতামাতার দ্বায়িত্ব পালন না করার বিষয়ে মহাভারতে কী বলা হয়েছে?” এই মহাকাব্যের গভীরে প্রবেশ করলে আপনি দেখতে পাবেন, বহু ঘটনার পেছনে লুকিয়ে আছে পিতামাতার দ্বায়িত্বের প্রতি অবহেলা বা ভুল বোঝাবুঝি। আজ আমি এই প্রসঙ্গে কিছু উদাহরণ এবং মহাভারতের কিছু মূল্যবান উদ্ধৃতি তুলে ধরব।

১. সন্তানের প্রতি মনোযোগের অভাব: ধৃতরাষ্ট্র ও দুর্যোধন

ধৃতরাষ্ট্র অন্ধ ছিলেন, শুধু দৃষ্টিহীন নয়, নিজের কর্তব্যের দিকেও অন্ধ। পিতা হিসাবে তিনি দুর্যোধনের ভুল সিদ্ধান্তগুলোর সময়ে তাকে সঠিক পথে আনতে ব্যর্থ হন। ধৃতরাষ্ট্র নিজেও জানতেন যে দুর্যোধনের ক্ষমতার লালসা এবং দুরাচারতা কৌরব এবং পাণ্ডবদের মধ্যে সংঘাত সৃষ্টি করবে। কিন্তু তিনি তাঁর পুত্রের ভুলকে সংশোধন করতে পারেননি।

মহাভারতে উল্লেখ আছে:
“যে পিতা পুত্রকে সঠিক পথে চালিত করতে পারে না, সে শুধু পুত্র নয়, সমাজের জন্যও দায়ী।”
ধৃতরাষ্ট্র নিজের দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়িয়ে পুত্রের প্রতি অন্ধ ভালবাসা দেখিয়েছিলেন। এই ভুলের ফলে, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে ওঠে।

আমরা কী শিখি? যদি আপনি সন্তানকে সঠিকভাবে দিকনির্দেশনা না দেন, তবে তার ক্ষতিকর প্রভাব শুধু পরিবারের উপর নয়, সমাজের উপরও পড়তে পারে।

২. প্রতিশ্রুতির ভুল বোঝাবুঝি: শন্তনু ও ভীষ্ম

রাজা শন্তনু এবং ভীষ্মের সম্পর্ক আমাদের এক নতুন দৃষ্টিকোণ শেখায়। শন্তনু নিজের প্রেমের জন্য গঙ্গাপুত্র দেবব্রতকে (পরবর্তীতে ভীষ্ম) এক অসম প্রতিজ্ঞায় আবদ্ধ করেছিলেন—তিনি আজীবন সিংহাসনে বসবেন না এবং বিবাহ করবেন না। এই প্রতিজ্ঞা রাজ্যের জন্য সুদূরপ্রসারী সমস্যা সৃষ্টি করেছিল।

ভীষ্ম পরবর্তীতে বলেছেন:
“পিতার আদেশ পালন করাই সন্তানের কর্তব্য, কিন্তু সেই আদেশ যদি সমাজের মূল নীতির পরিপন্থী হয়, তবে তা গ্রহণ করা উচিত নয়।”
শন্তনুর এই স্বার্থপরতা এবং ভীষ্মের অন্ধ আনুগত্য তাদের রাজ্য এবং পরিবারের উপর গভীর ছায়া ফেলেছিল।

আপনি কি কখনো ভেবেছেন, আপনার কোনও ইচ্ছা বা সিদ্ধান্ত সন্তানের জীবনে অপ্রত্যাশিত বোঝা হয়ে দাঁড়াতে পারে কি না?

৩. নৈতিক শিক্ষা দেওয়ার ব্যর্থতা: দ্রৌপদীকে অসম্মান

যখন কৌরব সভায় দুর্যোধন ও দুঃশাসন দ্রৌপদীকে অপমান করে, তখন ভীষ্ম, ধৃতরাষ্ট্র এবং অন্যান্য প্রবীণরা নীরব ছিলেন। পিতামাতা বা গুরুজনদের দায়িত্ব সন্তানের চরিত্র গঠনে সহায়তা করা। কিন্তু দুর্যোধন ও দুঃশাসনের ক্ষেত্রে এটি স্পষ্ট ছিল যে তারা সঠিক নৈতিক শিক্ষা পায়নি।

মহাভারতে বলা হয়েছে:
“ন্যায়ের পথে সন্তানকে চালিত করতে ব্যর্থ হলে, পিতা বা গুরুজনও পাপের অংশীদার হন।”
এই নীরবতা কেবল তাদের ব্যর্থতা নয়, এটি আরও বড় সংঘাতের সূচনা করেছিল।

আমরা এখানে শিখতে পারি যে সন্তানদের সঠিক সময়ে সঠিক শিক্ষা দেওয়া কতটা গুরুত্বপূর্ণ। আপনার নীরবতা কখনো কখনো আপনার ব্যর্থতাকে প্রকাশ করতে পারে।

৪. শাসনের অভাব: অর্জুন ও অভিমন্যু

অর্জুন, এক অসাধারণ যোদ্ধা হলেও, পিতার দায়িত্ব পালনে তিনি একাধিকবার ব্যর্থ হয়েছেন। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অভিমন্যু চক্রব্যূহ ভেদ করেছিল, কিন্তু পিতার কাছ থেকে সে পূর্ণ শিক্ষা পায়নি। অভিমন্যুর মৃত্যু আমাদের শেখায়, পিতামাতার দায়িত্ব সন্তানের পূর্ণ দক্ষতা বিকাশে সাহায্য করা।

মহাভারতের একটি বিখ্যাত উক্তি:
“অর্ধেক জ্ঞান সর্বদা বিপদের কারণ হয়।”
অর্জুন যদি অভিমন্যুকে পুরোপুরি প্রশিক্ষণ দিতেন, তাহলে হয়তো তাঁর এই অকালমৃত্যু এড়ানো যেত।

আপনার সন্তান কি আপনার কাছ থেকে পর্যাপ্ত দিকনির্দেশনা পাচ্ছে? না কি আপনার অমনোযোগ তাদের জীবনে বিপদ ডেকে আনছে?

৫. পিতৃস্নেহের অন্য দিক: কর্ণ ও কুন্তী

কুন্তী তাঁর প্রথম সন্তান কর্ণকে জন্মের পরই ত্যাগ করেছিলেন। যদিও পরিস্থিতি তাকে এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করেছিল, কিন্তু কর্ণের জীবনে এটি গভীর প্রভাব ফেলেছিল। কর্ণ জীবনের শেষ পর্যন্ত মায়ের স্নেহের অভাব অনুভব করেছিল।

কুন্তী কর্ণকে বলেছিলেন:
“পুত্র, আমি তোমাকে ত্যাগ করেছিলাম, কিন্তু তোমার প্রতি আমার ভালবাসা কখনো কমেনি।”
তবুও, এই প্রেম কুরুর যুদ্ধ থামাতে যথেষ্ট ছিল না। কর্ণ এবং পাণ্ডবদের মধ্যে বিভাজন তার এই ব্যর্থতার একটি ফল।

আপনি কি কখনো ভেবেছেন, আপনার কোনও কাজ কি আপনার সন্তানের উপর দীর্ঘস্থায়ী ক্ষত তৈরি করছে?

আপনার দায়িত্বের ছায়া

মহাভারতের উদাহরণ থেকে আমি এবং আপনি এক গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা নিতে পারি—পিতামাতার দ্বায়িত্ব কখনোই এড়ানো যায় না। সন্তানের প্রতি অবহেলা, ভুল নির্দেশনা, অথবা অন্ধ আনুগত্য তাদের জীবনে যে প্রভাব ফেলে, তা প্রজন্ম ধরে চলতে থাকে।

তাহলে, আপনি কি আপনার সন্তানের জন্য সঠিক উদাহরণ তৈরি করছেন? আপনার সিদ্ধান্ত কি তাদের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনছে? মহাভারতের এই প্রশ্নগুলো আজও আমাদের জীবনকে চিন্তা করতে শেখায়।

“পিতা-মাতা সন্তানের ভাগ্য গড়ার কারিগর। আপনি কি সেই দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছেন?”

আপনার মতামত আমাদের জানান। মহাভারত থেকে আরও কিছু শিখতে চান? আপনি কোন গল্প বা চরিত্র থেকে সবচেয়ে বেশি অনুপ্রাণিত? মন্তব্যে লিখুন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top