মোক্ষ কী এবং তা অর্জনের পথ কী?

আমরা জীবনের নানা পর্যায়ে এসে বারবার একটি প্রশ্নের মুখোমুখি হই—জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য কী? সুখ? সম্পদ? না কি পরম শান্তি? মহাভারত এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমাদের এক অসীম পথ দেখায়। মোক্ষ, অর্থাৎ চিরস্থায়ী মুক্তি, এই প্রশ্নের সমাধান হতে পারে। কিন্তু কী এই মোক্ষ? আর কীভাবে আমরা তা অর্জন করতে পারি? আসুন, মহাভারতের আলোকে এই গভীর বিষয়টি বুঝে নিই।

মোক্ষ: জীবন ও মৃত্যু থেকে মুক্তি

মহাভারতের ভাষায়, “মোক্ষ” হলো পুনর্জন্মের চক্র থেকে মুক্তি। এটি কেবল শারীরিক বা মানসিক শান্তি নয়, এটি আত্মার মুক্তি, যেখানে জীব আত্মা পরমাত্মার সাথে একাত্ম হয়। ভীষ্ম পিতামহ শিখিয়েছিলেন, “মোক্ষের পথ আত্মজ্ঞান এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের মধ্য দিয়ে অতিক্রান্ত।”

একটি উদাহরণ হিসেবে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের সময় অর্জুনের দ্বিধার কথা ধরা যাক। অর্জুন যখন নিজের আত্মীয়দের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে সংকোচ করছিল, তখন শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে বললেন:

“কর্ম করো, কিন্তু ফলের প্রতি আসক্তি রেখো না।”
এই একটি শিক্ষা মোক্ষের পথে অগ্রসর হওয়ার জন্য অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।

মোক্ষের পথে অগ্রসর হওয়ার কয়েকটি ধাপ

 আত্মজ্ঞান অর্জন

মোক্ষের প্রথম শর্ত হলো আত্মজ্ঞান। মহাভারতে বলা হয়েছে, “জ্ঞানের দ্বারা সমস্ত বন্ধন কেটে যায়।” শ্রীকৃষ্ণ গীতায় বলেছেন,

“যে নিজেকে এবং নিজের প্রকৃত সত্তাকে চিনতে পারে, সে-ই প্রকৃত জ্ঞানী।”
আমরা যখন আমাদের প্রকৃত সত্তাকে চিনতে পারি, তখন জীবনের সুখ-দুঃখ আমাদের প্রভাবিত করতে পারে না।

 কামনা এবং মোহ ত্যাগ

মোক্ষের পথে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হলো কামনা এবং মোহ ত্যাগ করা। মহাভারতে যুধিষ্ঠির বলেছিলেন,

“কামনাই মানুষের সবচেয়ে বড় শত্রু।”
যুধিষ্ঠির নিজেই কামনা ত্যাগের এক মহান উদাহরণ। রাজ্যপাট পাওয়ার পরও তিনি মোহমুক্ত হতে পাণ্ডবদের অরণ্যে নিয়ে যান।

 কর্মযোগ

শ্রীকৃষ্ণের কর্মযোগ তত্ত্ব মোক্ষের একটি শক্তিশালী মাধ্যম। তিনি অর্জুনকে বলেছিলেন:

“নিজের কর্তব্য পালন করাই শ্রেষ্ঠ ধর্ম।”
কর্মফল থেকে মুক্তি পেতে হলে নিজের কর্তব্যকে নিঃস্বার্থভাবে পালন করতে হবে।

 ধ্যান এবং ভক্তি

ধ্যান এবং ভক্তি মোক্ষের পথে আমাদের মনের শান্তি এনে দেয়। মহাভারতে বলা হয়েছে,

“পরমাত্মার প্রতি সম্পূর্ণ ভক্তিই মোক্ষের চাবিকাঠি।”
ভীষ্ম পিতামহ তাঁর জীবনের শেষ মুহূর্তে ভগবানের নাম স্মরণ করেই মোক্ষ প্রাপ্ত হন।

মহাভারতের উদাহরণ: মোক্ষের পথে প্রাসঙ্গিকতা

অর্জুনের কাহিনি

অর্জুন যখন শ্রীকৃষ্ণের উপদেশ গ্রহণ করে নিজের কর্তব্য পালন করলেন, তখন তিনি মোক্ষের পথে অগ্রসর হলেন। এটি আমাদের শেখায় যে জীবনযুদ্ধে জয়লাভের জন্য আত্মবিশ্বাস এবং কর্তব্যজ্ঞান অপরিহার্য।

কর্ণের শিক্ষা

কর্ণ ছিলেন এক মহান দাতা। তবে মোক্ষের পথে তাঁর ব্যর্থতার কারণ ছিল তাঁর প্রতিশোধস্পৃহা। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে মোহ এবং ক্রোধ মোক্ষের পথে প্রধান বাধা।

দ্রৌপদীর ক্ষমা

দ্রৌপদী, যাঁর জীবনে ছিল অসীম দুঃখ, তিনি ক্ষমার মাধ্যমে আত্মাকে শান্ত করেছিলেন। এটি মোক্ষের পথে ক্ষমার গুরুত্ব তুলে ধরে।

আপনি কীভাবে মোক্ষের পথে হাঁটবেন?

আপনার জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে কি আপনি শান্তি খুঁজছেন? মহাভারতের শিক্ষা হলো, মোক্ষের জন্য আপনাকে নিজের মধ্যে গভীর ধ্যান করতে হবে। নিজের ইন্দ্রিয়কে সংযম করতে হবে এবং পরমাত্মার প্রতি সম্পূর্ণ বিশ্বাস রাখতে হবে।

মহাভারতে বলা হয়েছে,

“যে নিজের মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, সে-ই পরমাত্মাকে অনুভব করতে পারে।”

শেষ কথা

জীবন একটি পরীক্ষা। মোক্ষের পথ কঠিন হলেও এটি চূড়ান্ত শান্তির পথ। মহাভারত আমাদের শিখিয়েছে যে মোক্ষ কোনো দূরের স্বপ্ন নয়, এটি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের কর্ম এবং চিন্তার ফল।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top