যুধিষ্ঠিরের রাজ্যাভিষেক কি তাকে প্রকৃত সুখ দিয়েছিল?

আমরা সবাই সুখের সন্ধান করি, তাই না? জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে, প্রতিটি সাফল্যের মুহূর্তে আমাদের প্রশ্ন থাকে—এটাই কি সত্যিকারের সুখ? মহাভারতের পাণ্ডবরাজ যুধিষ্ঠিরের গল্প আমাদের এই প্রশ্নের গভীরে নিয়ে যায়। রাজ্যাভিষেকের গৌরব কি তার জন্য প্রকৃত সুখ এনেছিল? আজ আমরা সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজব।

ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির: এক ন্যায়পরায়ণ শাসকের গল্প

তোমরা নিশ্চয়ই জানো, যুধিষ্ঠির তার ন্যায়পরায়ণতার জন্য “ধর্মরাজ” নামে পরিচিত। দ্যূতক্রীড়ায় সব হারানোর পর, তিনি ভাইদের নিয়ে বনবাসে যান এবং কষ্ট সহ্য করেন। কৌরবদের বিরুদ্ধে ১৮ দিনের মহাযুদ্ধ জিতে যখন তিনি হস্তিনাপুরের সিংহাসনে বসেন, তখন এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়। কিন্তু এই জয় কি তাকে তৃপ্তি দিয়েছিল? নাকি তার অন্তরে ছিল এক শূন্যতা?

রাজ্যাভিষেকের মুহূর্ত: বাহ্যিক জয়ের অন্তর্নিহিত বেদনা

যুধিষ্ঠিরের রাজ্যাভিষেক ছিল এক বিশাল উৎসব। রাজসূয় যজ্ঞে দেবতারা পর্যন্ত আশীর্বাদ করেছিলেন। কিন্তু তখনও যুধিষ্ঠিরের মন বিষণ্ণ। কেন? তিনি নিজেই বলেছিলেন—

“অহিংসা পরম ধর্ম, কিন্তু আমি যুদ্ধ করে বহু জীবন নষ্ট করেছি। এ কি ধর্মের পথে থাকা?”

তুমি কি এমন পরিস্থিতিতে পড়েছ, যেখানে তুমি বাইরের জগতে সফল, কিন্তু তোমার ভিতরে কোথাও একটা অপরাধবোধ কুরে কুরে খাচ্ছে? যুধিষ্ঠিরের এই অনুভূতি আমাদের সেই শিক্ষাই দেয় যে বাহ্যিক সাফল্য মানেই সুখ নয়।

সুখের সন্ধানে যুধিষ্ঠির

  •  দ্যূতক্রীড়ার পরিণতি: দ্যূতক্রীড়ায় নিজের সর্বস্ব হারিয়ে যুধিষ্ঠির যখন দ্রৌপদীকে হারান, তখন তার মনে যে দুঃখ জমা হয়েছিল, তা তিনি কখনও ভুলতে পারেননি। রাজ্যাভিষেকের পরও সেই স্মৃতি তাকে তাড়া করে ফিরত।
  •  যুদ্ধক্ষেত্রের মৃত্যু: যুদ্ধে কর্ণ, দ্রোণাচার্য এবং বহু আত্মীয়-স্বজনের মৃত্যু যুধিষ্ঠিরকে কুর্ণিশ করার আনন্দ থেকে বঞ্চিত করেছিল। তিনি বলেছিলেন—

“রাজত্ব পেলাম, কিন্তু প্রিয়জনদের হারালাম। এ কি প্রকৃত জয়?”

  •  গন্ধমাদন পর্বতের শিক্ষা: বনবাসকালে গন্ধমাদন পর্বতে ঋষি বৃষ্ণি যুধিষ্ঠিরকে বলেন—

“সুখ খুঁজে পাবে না যদি মন শান্ত না হয়। রাজ্য বা ধন তোমাকে তৃপ্তি দিতে পারবে না।”

যুধিষ্ঠির এই শিক্ষা গভীরভাবে গ্রহণ করেন, কিন্তু রাজ্যাভিষেকের পর তার মনের শান্তি হারিয়ে যায়।

মহাভারতের কিছু গভীর শ্লোক এবং তাদের তাৎপর্য

  •  “ধর্মো রক্ষতি রক্ষিতঃ” (যে ধর্ম রক্ষা করে, ধর্ম তাকে রক্ষা করে।) যুধিষ্ঠির সবসময় ধর্ম মেনে চলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু যুদ্ধ এবং রাজ্যাভিষেকের দায়িত্ব তার ধর্মচিন্তাকে আরও জটিল করে তোলে।
  •  “সুখাদুঃখে সমে কৃত্বা লাভালাভৌ জয়াজয়ৌ।” (সুখ-দুঃখ, লাভ-ক্ষতি, জয়-পরাজয় সমানভাবে গ্রহণ করো।) কৃষ্ণ বারবার যুধিষ্ঠিরকে এ শিক্ষা দিয়েছেন। কিন্তু যুধিষ্ঠির কি তা মেনে চলতে পেরেছিলেন? অন্তরের শান্তি হারিয়ে তিনি এই শ্লোকের তাৎপর্য খুঁজে বেড়িয়েছিলেন।
  •  “অহিংসা পরম ধর্মঃ” (অহিংসাই শ্রেষ্ঠ ধর্ম।) যুধিষ্ঠিরের অন্তরে অহিংসার প্রতি যে টান ছিল, তা যুদ্ধের সময় বারবার তার মনের দ্বন্দ্ব বাড়িয়েছিল।

তোমার জীবনে মহাভারতের প্রভাব

তুমি কি কখনও এমন অবস্থায় পড়েছ, যেখানে তুমি মনে করেছ—সব পেয়েও কোথাও একটা অপূর্ণতা রয়ে গেছে? যুধিষ্ঠিরের গল্প আমাদের শেখায়, সুখ খুঁজতে হলে নিজের অন্তরে তাকাতে হয়। বাইরের জগতের সাফল্য যদি তোমার হৃদয়কে শান্তি না দেয়, তবে তা প্রকৃত সাফল্য নয়।

যুধিষ্ঠির কি সুখী ছিলেন?

রাজ্যাভিষেকের পরও যুধিষ্ঠির বারবার বলেছিলেন—

“ধর্মপথে থেকেও আমি কি সত্যিই সুখী?”

তোমাকে ভাবতে হবে, তুমি যে লক্ষ্য স্থির করেছ, তা কি সত্যিই তোমার অন্তরের তৃপ্তি আনবে? না কি তোমার সুখ কোথাও অন্যত্র লুকিয়ে আছে?

সুখের প্রকৃত অর্থ খুঁজে নাও

যুধিষ্ঠিরের রাজ্যাভিষেক আমাদের শেখায়, সুখ বাহ্যিক নয়, অন্তরের। তাই আমি তোমাকে এই প্রশ্ন রেখে শেষ করতে চাই—তুমি কি সেই পথে চলছ, যা তোমার অন্তরকে শান্তি দেবে? মহাভারত পড়ো, নিজের জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে দেখো, আর খুঁজে বের করো সেই সত্যিকারের সুখ যা তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top