রাজনীতিতে প্রতিশোধ কীভাবে সহিংসতাকে উস্কে দিয়েছিল?

আপনার কি মনে হয় প্রতিশোধ কেবল শত্রুকে পরাজিত করার একটি উপায়? না কি এটি আপনার নিজের জীবনেও সহিংসতার বীজ বপন করে? মহাভারত, একটি মহাকাব্য যা আমাদের প্রতিদিনের জীবনে প্রাসঙ্গিক পাঠ শেখায়, বারবার দেখিয়েছে প্রতিশোধের বিষ কীভাবে সমগ্র সমাজকে ভয়ঙ্কর ধ্বংসের দিকে নিয়ে যেতে পারে। চলুন, এর থেকে আমরা শিক্ষা নিই।

প্রতিশোধের আগুনে কুরুক্ষেত্র

যখন আমি মহাভারত পড়ি, এক বিষয় স্পষ্ট হয়—প্রতিশোধের বশবর্তী হয়ে রাজনীতিতে একটি ক্ষুদ্র ঘটনার কীভাবে বিশাল সহিংসতার রূপ নিতে পারে। কৌরব এবং পাণ্ডবদের মধ্যেকার সংঘাতের মূল ছিল একটি ছোট প্রতিশোধ। দ্যূতক্রীড়ার সভায় দ্রৌপদীর অপমানের প্রতিশোধ নেওয়া ছিল পাণ্ডবদের মনের একমাত্র চিন্তা। আপনি নিশ্চয়ই মনে করতে পারেন, দ্রৌপদী নিজে বলেছিলেন:

“যেখানে ন্যায়বিচার নেই, সেখানে রাজত্ব করা অধর্ম।”

এই অনুভূতিই পাণ্ডবদের প্রতিশোধস্পৃহাকে আরো জোরালো করেছিল। কিন্তু সেই প্রতিশোধ কেবল ব্যক্তিগত সীমা অতিক্রম করে, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধকে ডেকে আনে। এখানে আপনি কী শিখতে পারেন? প্রতিশোধের চিন্তা কখনও একা আপনার জীবনে থেমে থাকে না; এটি আরও বড় সংঘর্ষে পরিণত হয়।

আপনার জীবনেও কি প্রতিশোধ সহিংসতা আনে?

আমি যখন নিজেকে প্রশ্ন করি, “আমার জীবনের কোন কোন ক্ষেত্রে প্রতিশোধ আমাকে অন্ধ করে দিয়েছে?”, তখন দেখি প্রতিশোধের প্রভাব আমাদের দৈনন্দিন সম্পর্ককেও নষ্ট করতে পারে। আপনার কি মনে পড়ে, কখনও কেউ আপনাকে অপমান করেছিল এবং আপনি সেই অপমানের প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিলেন? এই প্রতিশোধের ভাবনা কি আপনার শান্তি কেড়ে নিয়েছিল? মহাভারতের একটি বিখ্যাত উক্তি আমার মনকে শান্ত করে:

“ক্রোধ থেকে জন্মায় প্রতিশোধ, প্রতিশোধ থেকে সংঘর্ষ, সংঘর্ষ থেকে ধ্বংস।”

কৃষ্ণ এই শব্দগুলো বলেন যখন অর্জুন যুদ্ধের ময়দানে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। প্রতিশোধ নেওয়ার সময় আপনি যেমন নিজের নৈতিকতা হারান, তেমনই অন্যদেরকেও একই পথে টেনে নেন।

ভীষ্ম, কর্ণ এবং ধৃতরাষ্ট্রের ভুল

রাজনীতিতে প্রতিশোধের আরেকটি উদাহরণ হল ভীষ্ম এবং কর্ণের ভূমিকা। ভীষ্ম প্রতিশোধ নিতে চাননি, কিন্তু তিনি একধরনের নীরব সমর্থন দিয়েছিলেন কৌরবদের। কর্ণ, অন্যদিকে, নিজেকে দ্রৌপদীর অপমানের জন্য দায়ী না করেও কৌরবদের পক্ষে যুদ্ধ করেন শুধুমাত্র নিজের অপমানের প্রতিশোধ নিতে।

এখানে আপনি ভীষ্মের অবস্থান থেকে একটি পাঠ নিতে পারেন। তিনি ন্যায়ের পথে থেকেও নিরবতা পালন করে কৌরবদের পাশেই ছিলেন। এটা কি একধরনের পরোক্ষ সমর্থন নয়? মহাভারত আমাদের বলে:

“অধর্মের প্রতি নিরবতা, অধর্মকেই জিতিয়ে তোলে।”

আমার জীবনে, আমি এই বিষয়টি উপলব্ধি করেছি যে ন্যায়বিচারের জন্য দাঁড়ানো আর প্রতিশোধ নেওয়া একই জিনিস নয়। আপনারও এই শিক্ষাটি গ্রহণ করা উচিত।

মহাভারত থেকে প্রতিশোধের আরও উদাহরণ

আপনি কি জানেন, অভিমন্যুর মৃত্যু কেবলমাত্র প্রতিশোধের কারণে ঘটেছিল? চক্রব্যূহে প্রবেশ করতে পারলেও, তিনি বের হতে পারলেন না কারণ প্রতিশোধস্পৃহায় উন্মত্ত কৌরব সেনারা তাকে হত্যার ফাঁদে ফেলেছিল। এ থেকে শিক্ষা কী?

প্রতিশোধের পথে আপনি একা নন, এটি একটি শৃঙ্খল প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। প্রতিশোধ একবার শুরু হলে, এর সমাপ্তি হয় নি:শেষ সহিংসতায়।

আমি কী শিখেছি, এবং আপনি কী শিখতে পারেন?

এই প্রসঙ্গে একটি কথা আমার মনে পড়ে—শান্তি যদি স্থায়ী হয়, তবে ন্যায়বিচার হতে হবে প্রতিশোধহীন। মহাভারত বারবার বলে, প্রতিশোধ কখনোই সমস্যার সমাধান নয়। উদাহরণস্বরূপ, যখন অর্জুন যুদ্ধক্ষেত্রে শপথ করেন ভীষ্মকে হত্যা করার, কৃষ্ণ তাকে বারবার মনে করিয়ে দেন যে প্রতিশোধ নয়, ধর্ম রক্ষা তার প্রধান লক্ষ্য।

“তোমার লক্ষ্য ধর্মের রক্ষা করা, প্রতিশোধ নেওয়া নয়।”

আপনার জীবনে কখনো কি এমন হয়েছে যে আপনি প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য অনেক কিছু হারিয়েছেন? আপনি কি অনুভব করেছেন যে প্রতিশোধ কেবল আপনার মনের শান্তি নষ্ট করেছে?

রাজনীতির বর্তমান বাস্তবতা

আপনি যদি বর্তমান সমাজ এবং রাজনীতির দিকে তাকান, দেখতে পাবেন প্রতিশোধ কেবলমাত্র রাজনৈতিক প্রতিহিংসাকে বৃদ্ধি করে। এই প্রতিহিংসা কেবল শত্রুদের সংখ্যাই বাড়ায়, বন্ধুর সংখ্যা নয়।

যেমন মহাভারত আমাদের শেখায়:

“যে ব্যক্তি অপরের ক্ষতি করতে চায়, সে নিজের জীবনেও শান্তি পায় না।”

রাজনীতির ময়দানে এই বিষয়টি খুবই প্রাসঙ্গিক। আপনি যদি প্রতিশোধের রাস্তা ত্যাগ করে আলোচনার পথ খুঁজে পান, তবে শান্তির সম্ভাবনা অনেক বেশি।

প্রতিশোধের চক্র থেকে মুক্তি কীভাবে সম্ভব?

শেষে, আমি আপনাকে এই প্রশ্নটি ছেড়ে যেতে চাই: আপনি কি সেই শক্তিশালী ব্যক্তি হতে চান, যে ক্ষমা করে শান্তি প্রতিষ্ঠা করে? নাকি আপনি সেই দুর্বল ব্যক্তি, যে প্রতিশোধের পথ বেছে নিয়ে নিজেকে এবং অন্যদের ধ্বংস করে?

মহাভারত আমাদের শিখিয়েছে, ক্ষমা হল সবচেয়ে বড় শক্তি। কৃষ্ণ বলেছেন:

“ক্ষমা সেই শক্তি, যা সহিংসতাকে শেষ করে এবং শান্তিকে স্থায়ী করে।”

এখন সিদ্ধান্ত আপনার।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top