আপনারা যদি মহাভারতের গল্পে ডুবে গিয়ে শকুনির চরিত্রটা বিশ্লেষণ করেন, তবে দেখতে পাবেন—শকুনির উপস্থিতি কৌরবদের রাজনীতি এবং পারিবারিক সম্পর্কের জটিলতাকে এক ভিন্ন স্তরে নিয়ে গিয়েছিল। এই প্রাচীন মহাকাব্য শুধু যুদ্ধ আর রক্তপাতের কাহিনি নয়; বরং এটি মানুষের স্বভাব, রাজনৈতিক চক্রান্ত, এবং ক্ষমতার মোহের এক অনবদ্য দলিল। আজকের আলোচনায় আমরা শকুনির ভূমিকাকে বিশ্লেষণ করব এবং দেখব, কিভাবে তিনি ভূরাজনৈতিক সংকটকে আরও গভীর এবং জটিল করে তুলেছিলেন।
শকুনির পেছনের গল্প
আপনি কি জানেন, শকুনির এভাবে চক্রান্তের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠার পেছনে তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাগুলো কতটা প্রভাব ফেলেছিল? তিনি ছিলেন গান্ধারের রাজা সুবালের পুত্র, দ্রৌপদীর মামা। তাঁর বোন গান্ধারীকে দৃষ্টিহীন ধৃতরাষ্ট্রের সঙ্গে বিবাহ দেওয়া হয়েছিল, যা শকুনির মনে এক চিরস্থায়ী ক্ষোভ তৈরি করেছিল।
শকুনির এই ক্ষোভ শুধু ব্যক্তিগত প্রতিশোধের ইন্ধন জোগায়নি, বরং তা ধীরে ধীরে একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক পরিকল্পনার রূপ নেয়। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল কৌরবদের ধ্বংস করা এবং নিজের জন্মভূমি গান্ধারের প্রতিশোধ নেওয়া।
জটিল চক্রান্তের সূচনা
শকুনির চক্রান্তের সবচেয়ে সুস্পষ্ট উদাহরণ হলো পাশা খেলার ঘটনা। মনে আছে, যুধিষ্ঠির যখন নিজের রাজ্য, ধন-সম্পদ, এবং এমনকি দ্রৌপদীকেও বাজি ধরেছিলেন? শকুনি অত্যন্ত চালাকির সঙ্গে পাশা খেলায় কারচুপি করে যুধিষ্ঠিরকে পরাজিত করেন।
এই ঘটনাই মূলত কৌরব এবং পান্ডবদের মধ্যে বিরোধকে চরমে পৌঁছে দিয়েছিল। মহাভারতে বলা হয়েছে:
“জ্যেষ্ঠ যুধিষ্ঠির বললেন, ‘আমি আবারও খেলতে চাই।’ শকুনি হেসে বললেন, ‘তোমার ইচ্ছাই আমার আদেশ।'”
এই উক্তি থেকেই স্পষ্ট, শকুনির মূল উদ্দেশ্য ছিল যুধিষ্ঠিরের দুর্বলতাকে কাজে লাগানো।
রাজনীতির মোড়
আপনার কি মনে হয়, শকুনি শুধু এক ব্যক্তিগত প্রতিশোধে সীমাবদ্ধ ছিলেন? না, তিনি ছিলেন একজন দূরদর্শী রাজনৈতিক খেলোয়াড়। শকুনির পরিকল্পনা ছিল ধীরে ধীরে পান্ডবদের এমনভাবে দুর্বল করা যাতে কৌরবরা সহজেই তাদের পরাজিত করতে পারে।
শকুনি একাধিকবার দুর্যোধনকে উত্তেজিত করে এমন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করেছিলেন, যা ধৃতরাষ্ট্রের রাজত্বকে দুর্বল করে তোলে। যেমন, ইন্দ্রপ্রস্থে সভা তৈরির সময় দুর্যোধনকে প্ররোচিত করে তিনি পান্ডবদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ বাড়িয়েছিলেন। মহাভারতে বলা হয়েছে:
“শকুনির মধুর বাক্যের মধ্যে ছিল বিষ। দুর্যোধন সেই বিষ পান করেছিল।”
আপনার জীবনে শিক্ষার প্রয়োগ
মহাভারতের এই অংশগুলো কি আপনাকে নিজের জীবনের রাজনৈতিক বা পারিবারিক চক্রান্তের কথা মনে করিয়ে দেয় না? আপনি কি কখনও এমন পরিস্থিতিতে পড়েছেন, যেখানে কারও কথায় বিভ্রান্ত হয়ে ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছেন?
শকুনির চরিত্র আমাদের শেখায়, কৌশল ও চক্রান্তে জড়িত থাকলে তা কেবল ধ্বংসই ডেকে আনে। নিজের বুদ্ধি খাটানো এবং সতর্ক থাকা যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা মহাভারত বারবার প্রমাণ করে।
সমাপ্তি
শেষ করার আগে আমি আপনাকে একটা প্রশ্ন করতে চাই: আপনি কি জীবনের যেকোনো জটিল পরিস্থিতিতে শকুনির মতো কারও প্রভাবকে সঠিকভাবে শনাক্ত করতে পারেন? মহাভারত আমাদের শেখায়, শত্রু শুধুমাত্র বাহ্যিক নয়; তা অনেক সময় আমাদের নিকট আত্মীয়ের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে। আপনি কীভাবে সেই শত্রুকে মোকাবিলা করবেন?
মহাভারতের শিক্ষা গ্রহণ করুন, নিজের বুদ্ধি ব্যবহার করুন এবং সঠিক পথ বেছে নিন। কারণ শকুনির মতো চক্রান্তকারী যে কেবল গল্পের চরিত্র নয়, তা আমাদের বাস্তব জীবনেই প্রমাণিত।