মহাভারত পড়তে গিয়ে আমরা সকলেই শকুনির নাম শুনেছি। কৌরবদের প্রধান কৌশলবিদ, শকুনি এমন একজন ব্যক্তি যিনি তার বুদ্ধি ও কূটকৌশল দিয়ে পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের জাল বুনেছিলেন। কিন্তু কখনো কি ভেবেছেন, শকুনির আচরণের পিছনে কোনো মানসিক চাপ বা ব্যথা লুকিয়ে ছিল?
আপনারা অনেকেই হয়তো ভাবছেন, শকুনির চরিত্র এতটাই নেগেটিভ যে সেখানে দয়া বা সমবেদনার কোনো জায়গা নেই। কিন্তু মহাভারতের গভীরে গেলে আমরা দেখতে পাই যে শকুনির জীবনের কিছু ঘটনা তাকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করেছিল। আজ আমরা সেই দিকটি বিশ্লেষণ করব।
শকুনির জীবনের প্রেক্ষাপট
শকুনি গান্ধারের রাজপুত্র ছিলেন। তার বোন গান্ধারীকে যখন অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হয়, তখন শকুনির পরিবারে একটি বড় আঘাত লাগে। গান্ধারী এই বিয়েতে একপ্রকার বাধ্য হয়েছিলেন, এবং শকুনি এটা কখনোই মেনে নিতে পারেননি। তিনি মনে করেছিলেন যে কৌরব রাজপরিবারের জন্য তার বোন এবং তাদের পরিবার অপমানিত হয়েছে। এই অনুভূতিই শকুনির মনে প্রতিহিংসার বীজ বপন করেছিল।
এখানে একটি প্রশ্ন উঠে আসে—আপনারা যদি শকুনির জায়গায় থাকতেন, আপনি কী করতেন? যদি আপনার প্রিয়জনের সাথে অন্যায় হতো, তাহলে কি আপনি সহজে সেটা ভুলে যেতে পারতেন?
শকুনির মানসিক যন্ত্রণা
আমরা মহাভারতের একাধিক অংশে শকুনির যন্ত্রণা স্পষ্ট দেখতে পাই। একটি উদাহরণ দিলে বোঝা যাবে। যখন গান্ধারীর ১০০ ভাইকে ভীষ্ম বন্দি করেন এবং তাদের অনাহারে হত্যা করেন, তখন শকুনি নিজের চোখের সামনে এই ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখেছিলেন। এমন পরিস্থিতি যে কারও মনকে বিষণ্ন এবং প্রতিহিংসাপ্রবণ করে তুলতে পারে।
মহাভারতে বলা হয়েছে:
“যে ব্যক্তি তার পরিবারের প্রতি অবিচার সহ্য করতে পারে না, তার হৃদয় জ্বলন্ত অগ্নিতে পরিণত হয়। সেই আগুন তার জীবনকে অন্ধকারে ভরিয়ে তোলে।”
আপনার জীবনেও হয়তো এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে যেখানে আপনাকে অবিচার সহ্য করতে হয়েছে। সেই অভিজ্ঞতা কীভাবে আপনার চিন্তাভাবনাকে প্রভাবিত করেছিল, তা একবার ভাবুন। শকুনির ক্ষেত্রেও এমনই কিছু ঘটেছিল।
শকুনির কূটকৌশল এবং তার পেছনের মানসিকতা
শকুনির প্রতিহিংসাপ্রবণ মনোভাব তাকে কৌশলগতভাবে দক্ষ করে তোলে। পাশার খেলায় তার অসামান্য দক্ষতা এর উদাহরণ। তিনি জানতেন কৌরবদের দুর্বলতা কী এবং কীভাবে সেই দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে পাণ্ডবদের ক্ষতি করা যায়।
একটি বিশেষ উদাহরণ হলো পাশার খেলা। শকুনি জানতেন যে দুর্যোধনের অহংকার এবং দুর্বল ইচ্ছাশক্তি তাকে সহজেই প্রভাবিত করতে পারে। এই খেলায় পাণ্ডবরা তাদের রাজ্য এবং এমনকি দ্রৌপদীকেও হারিয়েছিল। কিন্তু যদি আমরা গভীরে ভাবি, শকুনির এই আচরণের মূল কারণ কী ছিল?
মানসিক চাপের প্রভাব
শকুনির জীবনে মানসিক চাপ এবং পারিবারিক দ্বন্দ্ব তাকে একটি বিষাক্ত চরিত্রে পরিণত করেছিল। তিনি বারবার মনে করতেন, তার বোনের প্রতি হওয়া অন্যায়ের প্রতিশোধ তাকে নিতেই হবে। এই মানসিক চাপই তাকে ধীরে ধীরে কূটকৌশলের পথে চালিত করেছিল।
আমরা নিজের জীবনেও দেখি, যখন মানসিক চাপ আমাদের উপর নিয়ন্ত্রণ নেয়, তখন আমরা এমন কাজ করি যা পরে আমাদের জন্য ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়ায়। মহাভারতে বলা হয়েছে:
“অপরের ক্ষতি করতে গিয়ে যে ব্যক্তি তার নিজের শান্তি হারায়, সে নিজের জীবন ধ্বংস করে।”
শকুনির ক্ষেত্রেও এটি সত্যি ছিল। প্রতিহিংসার আগুনে পুড়ে তিনি নিজেই ধ্বংস হয়েছিলেন।
আমরা কী শিখতে পারি?
শকুনির জীবন আমাদের শেখায় যে প্রতিহিংসা এবং মানসিক চাপ কীভাবে আমাদের ভুল পথে চালিত করতে পারে। যখন আপনি কোনো অন্যায়ের শিকার হন, তখন প্রতিশোধ নেওয়ার আগে ভাবুন—আপনার এই কাজ কি সত্যিই আপনার জীবনে শান্তি আনবে?
মহাভারতের আরও একটি উক্তি এখানে মনে করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন:
“যে ব্যক্তি ক্ষমা করতে শেখে, সে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ।”
আপনার জীবনেও যদি কোনো শকুনির মতো পরিস্থিতি আসে, তাহলে আপনি কীভাবে সেটাকে সামলাবেন? শকুনির মতো প্রতিহিংসার পথে হাঁটবেন, নাকি ক্ষমার মাধ্যমে নিজের মানসিক শান্তি খুঁজে নেবেন?
শেষ কথা
শকুনির জীবন আমাদের একটি গভীর বার্তা দেয়—মানসিক চাপ এবং প্রতিহিংসার মতো বিষয় আমাদের জীবনের দিক পরিবর্তন করে দিতে পারে। আমাদের উচিত নিজের জীবনে এমন বিষাক্ত আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করা।
আপনি কি মনে করেন, মহাভারতের এই শিক্ষা আজকের দিনে প্রাসঙ্গিক? শকুনির জীবনের গল্প থেকে আপনি কী শিখলেন?
ভাবুন এবং নিজের জীবনে মহাভারতের এই নীতিগুলো প্রয়োগ করার চেষ্টা করুন।