শকুনি কি ধৃতরাষ্ট্রের প্রতি সত্যিকারের বিশ্বস্ত ছিলেন?

আমরা যখন মহাভারতের দিকে তাকাই, তখন শকুনির চরিত্র এক বিশেষভাবে আলোচিত এবং বিতর্কিত অধ্যায় হয়ে ওঠে। আপনি হয়তো অনেকবার ভাবছেন, শকুনি কি ধৃতরাষ্ট্রের প্রতি সত্যিই বিশ্বস্ত ছিলেন, নাকি তাঁর সব কর্মকাণ্ডের পিছনে ছিল একটি গভীর ষড়যন্ত্র? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের মহাভারতের কাহিনির গভীরে প্রবেশ করতে হবে।

শকুনির পরিচয় ও প্রেক্ষাপট

শকুনি ছিলেন গান্ধারের রাজা। ধৃতরাষ্ট্রের স্ত্রী গান্ধারীর ভাই হিসেবে তিনি হস্তিনাপুর রাজপরিবারের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। বলা হয়, শকুনির জীবন ও কর্মে দুটি বড় দিক ছিল। একদিকে তিনি ছিলেন গান্ধারের রাজকুমার, আর অন্যদিকে ধৃতরাষ্ট্রের পরিবারে তাঁর ভূমিকা ছিল এক কূটনৈতিক এবং রাজনৈতিক পরামর্শদাতার। কিন্তু তাঁর কর্মপন্থা প্রায়ই ছিল ধূর্ত ও ধ্বংসাত্মক।

ধৃতরাষ্ট্রের প্রতি শকুনির ভূমিকা

ধৃতরাষ্ট্র ছিলেন জন্মান্ধ এবং ক্ষমতার প্রতি প্রবল আসক্ত। এমন অবস্থায় শকুনি তাঁর পাশে একজন পরামর্শদাতা হিসেবে ছিলেন। প্রথমে আপনি ভাবতে পারেন, শকুনি ছিলেন ধৃতরাষ্ট্রের প্রতি বিশ্বস্ত। কারণ তিনি সর্বদা কৌরবদের পক্ষেই পরামর্শ দিতেন। কিন্তু গভীরে গেলে আমরা দেখতে পাই, শকুনির কৌশল এবং পরামর্শ কৌরবদের ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিয়েছিল।

শকুনির প্রথম বড় ভূমিকা দেখা যায় পাশা খেলায়। তিনি ধৃতরাষ্ট্রকে বুঝিয়েছিলেন, পাশার মাধ্যমে পাণ্ডবদের সম্পদ ও রাজ্য দখল সম্ভব। ধৃতরাষ্ট্র, তাঁর অন্ধ ক্ষমতার লালসার কারণে, শকুনির কৌশলে সম্মতি দিয়েছিলেন।

মহাভারতে উল্লেখ রয়েছে:

“যিনি অন্যের ধ্বংসের কৌশল করেন, তিনি নিজের ধ্বংসও অবধারিত করেন।” (মহাভারত, আদিপর্ব)

এটি শকুনির চরিত্রের মূল চালিকাশক্তি। তিনি ধৃতরাষ্ট্রকে ব্যবহার করে নিজের প্রতিশোধ নিতেই ছিলেন অঙ্গীকারবদ্ধ।

শকুনির আসল উদ্দেশ্য

এখানে প্রশ্ন আসে, শকুনি কেন এমন করলেন? শোনা যায়, গান্ধার রাজ্যের প্রতি কুরু বংশের অবিচার শকুনির মনে গভীর ক্ষোভের সৃষ্টি করেছিল। গান্ধারীকে একশ ছেলের জন্ম দেওয়ার অভিশাপের সাথে বিয়ে দেওয়া এবং তাঁদের রাজ্যকে দুর্বল করার ষড়যন্ত্র শকুনিকে প্রতিশোধপরায়ণ করে তুলেছিল। তিনি ধৃতরাষ্ট্র এবং তাঁর পরিবারকে ধ্বংস করার পরিকল্পনা করেছিলেন।

এখানে একটি ঘটনা মনে করিয়ে দেওয়া যেতে পারে। যখন যুধিষ্ঠির পাশা খেলায় তাঁর রাজ্য, ভাই, এবং স্ত্রী দ্রৌপদীকেও বাজি রাখলেন, তখন শকুনিই ছিলেন সেই খেলার কূটকৌশলী।

মহাভারতে বলা হয়েছে:

“অধর্মের পথে চললে ধর্মও রুষ্ট হয়।” (মহাভারত, সভাপর্ব)

শকুনির এই অধার্মিক কর্মকাণ্ড কৌরবদের ধ্বংস ডেকে আনতে সময় নেয়নি।

ধৃতরাষ্ট্রের নৈতিক দুর্বলতা

ধৃতরাষ্ট্র নিজেই ছিলেন নৈতিকভাবে দুর্বল। তিনি তাঁর সন্তানদের ভুল কাজগুলো দেখেও কখনও বাধা দেননি। যখন শকুনি পাশার খেলার মাধ্যমে পাণ্ডবদের সর্বস্বান্ত করছিলেন, তখনও ধৃতরাষ্ট্র নীরব ছিলেন।

মহাভারতে ধৃতরাষ্ট্রের চরিত্র সম্পর্কে বলা হয়েছে:

“যিনি সঠিক পথ জানেন, কিন্তু তা অনুসরণ করেন না, তিনি অন্ধ নয়, অন্ধকার।” (মহাভারত, উদ্যোগপর্ব)

ধৃতরাষ্ট্রের এই নৈতিক দুর্বলতাকে শকুনি ভালোভাবেই বুঝেছিলেন এবং সেটি নিজের স্বার্থে ব্যবহার করেছিলেন। তিনি জানতেন, ধৃতরাষ্ট্রের ক্ষমতার লোভ এবং সন্তানের প্রতি অন্ধ স্নেহ তাঁকে যেকোনো কিছু করতে প্ররোচিত করবে।

শকুনির কৌশলের ফলাফল

শকুনির পরামর্শে ধৃতরাষ্ট্র এবং কৌরবরা এমন এক পথে পা বাড়িয়েছিলেন যা কেবল ধ্বংসের দিকে নিয়ে গিয়েছিল। পাশা খেলায় দুঃশাসনের দ্বারা দ্রৌপদীর অপমান, পাণ্ডবদের বনবাস, এবং শেষ পর্যন্ত মহাভারতের যুদ্ধ—এসবই শকুনির কৌশলের ফলাফল।

তবে আপনি যদি ভেবে দেখেন, শকুনির উদ্দেশ্য শুধু ধৃতরাষ্ট্রের সাহায্য করা ছিল না। তাঁর সব পরিকল্পনার পিছনে ছিল প্রতিশোধ এবং কৌরবদের ধ্বংসের ইচ্ছা।

শিক্ষা যা আমরা পেতে পারি

মহাভারত আমাদের শিখিয়েছে, প্রতিটি কাজের পিছনে একটি উদ্দেশ্য থাকে এবং সেই উদ্দেশ্যের ভিত্তি যদি ভুল হয়, তবে তার ফলাফলও ধ্বংসাত্মক হয়। শকুনির চরিত্র আমাদের এই শিক্ষা দেয় যে অন্যায় বা প্রতিশোধের পথে চললে নিজের সাথেও অন্যায় করা হয়।

আপনি যদি নিজের জীবনে মহাভারতের এই নীতি প্রয়োগ করেন, তাহলে দেখতে পাবেন, সৎ পথে চলা এবং ধৈর্য ধারণ করা সর্বদা ফলপ্রসূ হয়। শকুনির মতো কাউকে বিশ্বাস করার আগে তার আসল উদ্দেশ্য বোঝার চেষ্টা করুন।

শেষ কথা

শকুনি কি ধৃতরাষ্ট্রের প্রতি সত্যিকারের বিশ্বস্ত ছিলেন? উত্তরটি সহজ—না। শকুনির লক্ষ্য ছিল ধৃতরাষ্ট্রকে ব্যবহার করে কৌরব বংশকে ধ্বংস করা। তবে এর মধ্য দিয়ে তিনি নিজেও ধ্বংস হয়ে গিয়েছিলেন।

মহাভারতের একটি অমর উক্তি দিয়ে শেষ করছি:

“জীবনে ধর্মের পথ থেকে বিচ্যুত হলে, তা শেষ পর্যন্ত ধ্বংসের পথেই নিয়ে যায়।” (মহাভারত, শান্তিপর্ব)

তাহলে, আপনি কি ধৃতরাষ্ট্রের মতো অন্যের ভুল পরামর্শে নিজের জীবনকে বিপন্ন করবেন, নাকি সঠিক পথে নিজেকে পরিচালিত করবেন? সিদ্ধান্ত আপনার।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top