শত্রুদের প্রতি পাণ্ডবদের প্রতিশোধ স্পৃহা কি সন্ত্রাসের উদাহরণ?

আমরা সবাই জানি যে, মহাভারতের কেন্দ্রীয় কাহিনী কৌরব ও পাণ্ডবদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব। দুঃশাসনের দ্বারা দ্রৌপদীর অপমান এবং রাজসূয় যজ্ঞে দুর্যোধনের ঈর্ষাপূর্ণ মনোভাব পাণ্ডবদের কাছে কেবল পারিবারিক বিবাদের চেয়ে অনেক বেশি কিছু ছিল। এই অপমান এবং অধিকার হরণের প্রতিশোধ নেওয়ার পেছনে পাণ্ডবদের যে প্রেরণা কাজ করেছিল, তা কি সন্ত্রাসবাদী মনোভাবের সমতুল্য? নাকি এটি ছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামের একটি রূপ?

প্রতিশোধের মূল উৎস: দ্রৌপদীর অপমান

দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের ঘটনাটি মহাভারতের সবচেয়ে করুণ এবং উত্তেজনাপূর্ণ অংশগুলোর মধ্যে একটি। দুঃশাসন যখন দ্রৌপদীর সম্মান লঙ্ঘন করে, তখন দ্রৌপদী কৃপণ কণ্ঠে ভগবান কৃষ্ণকে ডেকে বলেন, “যে অধিকার হরণ করে, তার বিনাশ হওয়া আবশ্যক।” (মহাভারত, সভা পর্ব)। এই ঘটনা শুধুমাত্র দ্রৌপদীর অপমান নয়; এটি মানব সভ্যতার মূল মূল্যবোধের উপর আঘাত।

এই অপমানের ফলে যুধিষ্ঠিরের প্রতিজ্ঞা এবং ভীমের শপথ আসে। ভীম বলেন, “আমি দুঃশাসনের বুক চিরে তার রক্ত পান করবো।” শোনা যেতে পারে এটি নির্মমতা, কিন্তু এই শপথ কি সন্ত্রাসবাদী মনোভাবের প্রকাশ, নাকি এটি ন্যায়বিচারের জন্য একটি দৃঢ় সংকল্প? আপনি যদি একজন ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তির মতো ভাবেন, তবে দেখবেন এই প্রতিজ্ঞাগুলি অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামেরই প্রতীক।

কৃষ্ণের ভূমিকা: ন্যায়বিচার না সন্ত্রাস?

মহাভারতে শ্রীকৃষ্ণ বারবার ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য পাণ্ডবদের সমর্থন করেছেন। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে তিনি অর্জুনকে গীতার জ্ঞান দেন, যেখানে তিনি বলেন, “যে ধর্মের জন্য যুদ্ধ করে, তার পাপ হয় না।” (ভগবদ্গীতা, অধ্যায় ২, শ্লোক ৩১)। শ্রীকৃষ্ণ যদি সন্ত্রাসবাদ সমর্থন করতেন, তবে তিনি নিরপেক্ষ বা অযৌক্তিক হতেন। কিন্তু তিনি স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোই প্রকৃত ধর্ম।

আপনার জীবনেও যদি কোনো অন্যায় ঘটে, তবে কীভাবে আপনি সেটির প্রতিবাদ করবেন? এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ যে আমরা বুঝি, কৃষ্ণ পাণ্ডবদের প্রতিশোধ স্পৃহাকে সন্ত্রাস নয়, বরং ধর্মের পুনঃপ্রতিষ্ঠা হিসেবে দেখিয়েছেন।

শত্রুদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি: ভীম বনাম অর্জুন

পাণ্ডবদের প্রতিশোধ স্পৃহায় ভিন্নতা ছিল। ভীম যেখানে প্রতিশোধকে ব্যক্তিগত রাগের মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন, সেখানে অর্জুন ছিলেন তুলনামূলক শান্ত এবং ধর্মের প্রতি নিবেদিত। অর্জুন কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের আগে দোটানায় পড়ে বলেন, “আমি কীভাবে আমার নিজের আত্মীয়দের হত্যা করব?” (ভগবদ্গীতা, অধ্যায় ১, শ্লোক ২৮)। এই প্রশ্নে আপনারাও কি কখনো দ্বিধায় পড়েছেন? জীবনের কঠিন মুহূর্তে আমরা নিজেরাই ঠিক-ভুলের দোলাচলে পড়ি।

শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে স্পষ্ট করে দেন যে, যুদ্ধটা ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য এবং এর পেছনে কোনো ব্যক্তিগত শত্রুতা নেই। “ধর্মের জন্য কর্ম করো, ফলের আশা ছেড়ে দাও,” (ভগবদ্গীতা, অধ্যায় ২, শ্লোক ৪৭) এই বার্তাটি অর্জুনকে সাহস দেয়।

ন্যায়ের প্রতিশোধ বনাম সন্ত্রাস

  •  ভীষ্মের মৃত্যু: ভীষ্ম পিতামহ যুদ্ধের সময় পান্ডবদের পক্ষ না নিলেও ধর্মের জন্য তার পতন ঘটে। এটি সন্ত্রাস নয়, বরং একটি দৃষ্টান্ত যে অন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ালে ফল ভোগ করতে হয়।
  •  দ্রোণাচার্যের মৃত্যু: যুধিষ্ঠির কৌশলে দ্রোণাচার্যকে পরাজিত করেন। এটি হয়তো কৌশলগত চাল, কিন্তু এটি ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য ছিল।
  •  শকুনির পতন: শকুনি তার প্রতারণার জন্য পাণ্ডবদের শত্রু হয়ে ওঠেন। তার মৃত্যু অন্যায়কারীদের জন্য একটি শিক্ষা।
  •  দুর্যোধনের পতন: ভীম যখন দুর্যোধনের উরু ভেঙে দেন, তখন এটি নৈতিকতার একটি উদাহরণ যে অহংকারের পতন নিশ্চিত।
  •  অশ্বত্থামার অপমান: যুদ্ধশেষে অশ্বত্থামা যখন ব্রহ্মাস্ত্র ব্যবহার করেন, তখন পাণ্ডবরা তাকে ক্ষমা না করলেও হত্যা করেননি। এটি দেখায় যে প্রতিশোধেরও একটি সীমা আছে।

প্রতিশোধ কি জীবনে প্রয়োজন?

আপনার জীবনে কখনো কি এমন পরিস্থিতি এসেছে, যেখানে আপনি প্রতিশোধ নিতে চেয়েছেন? মহাভারতের কাহিনী আমাদের শেখায় যে প্রতিশোধ তখনই গ্রহণীয়, যখন তা ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য হয়। কিন্তু এটি ব্যক্তিগত রাগ বা হিংসা থেকে নয়, বরং বৃহত্তর কল্যাণের উদ্দেশ্যে হওয়া উচিত।

আপনি যখন কারো প্রতি রাগ অনুভব করেন, তখন একবার ভাবুন, সেই রাগ কি সৃষ্টিশীল কিছু করতে আপনাকে অনুপ্রাণিত করতে পারে? পাণ্ডবদের মতোই, আমরা যদি আমাদের রাগকে সঠিক পথে পরিচালিত করি, তবে তা আমাদের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারে।

প্রতিশোধের অর্থ পুনঃবিবেচনা

মহাভারত আমাদের শেখায় যে, শত্রুদের প্রতি প্রতিশোধ স্পৃহা সন্ত্রাস নয়, যদি তা ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য হয়। কিন্তু প্রতিশোধ গ্রহণ করার সময় আমাদের বিবেককে জাগ্রত রাখতে হবে। ভগবদ্গীতার সেই অমোঘ বাণী মনে রাখুন, “কর্ম করো, কিন্তু ফলের প্রতি আসক্ত হয়ো না।”

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top