সম্পদ ও ক্ষমতা কি মহাভারতে সুখ এনে দিয়েছিল?

মহাভারত—এই মহাকাব্য শুধু এক মহাকাব্য নয়, এটি জীবনের নানা দিক তুলে ধরেছে। এখানে প্রশ্ন উঠেছে: সম্পদ ও ক্ষমতা কি সত্যিই সুখ এনে দেয়? মহাভারতের গল্প আমাদের শেখায় যে সুখের প্রকৃত সংজ্ঞা ভোগবিলাস বা ক্ষমতার মাঝে নয়, বরং ধর্ম, সততা, ও আত্মতৃপ্তির মাঝে লুকিয়ে আছে।

সম্পদ ও ক্ষমতার ধাঁধা: দুর্যোধনের উদাহরণ

দুর্যোধন, কৌরবদের রাজপুত্র, ছিল অগাধ সম্পদের মালিক। তার ছিল প্রাসাদ, সেনাবাহিনী, এবং অসীম ক্ষমতা। কিন্তু সুখ? সেটা কি সে খুঁজে পেয়েছিল? দুর্যোধনের জীবনটাই ছিল ঈর্ষা, ক্রোধ, ও প্রতিশোধের জ্বালায় পূর্ণ। তার একটি বিখ্যাত উক্তি হলো:

“জানামি ধর্মং ন চে মে প্রবৃত্তি, জানামি অধর্মং ন চে মে নিবৃত্তি।”
(আমি জানি ধর্ম কী, কিন্তু সেটি পালন করতে পারি না; আমি জানি অধর্ম কী, তবু সেটি ত্যাগ করতে পারি না।)

এই উক্তি স্পষ্ট করে যে সম্পদ ও ক্ষমতা দুর্যোধনকে শান্তি দিতে পারেনি। বরং তার ঈর্ষাপূর্ণ মন তাকে সর্বদা অশান্ত রাখত।

যুধিষ্ঠির: সত্য ও ধর্মের প্রতীক

যুধিষ্ঠির, পাণ্ডবদের বড় ভাই, ছিলেন ধর্মরাজ। তিনি সম্পদ ও ক্ষমতার মালিক না হয়েও শান্তির সন্ধান করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন:

“সত্যং ধর্মম সর্বং ধর্ম।”
(সত্যই ধর্ম, আর ধর্মই সকল সুখের মূল।)

যদিও যুধিষ্ঠির পাশা খেলায় নিজের রাজ্য এবং স্ত্রী দ্রৌপদীকেও হারিয়ে ফেলেছিলেন, তিনি কখনো ধর্মের পথ থেকে বিচ্যুত হননি। তার জীবনের এই অধ্যায় আমাদের শেখায় যে ভুল করলেও, ন্যায়ের পথে ফিরে আসাই জীবনের প্রকৃত লক্ষ্য।

দ্রৌপদী: সম্মান বনাম সম্পদ

দ্রৌপদী, পাঁচ পাণ্ডবের স্ত্রী, মহাভারতে নারীর শক্তির এক মূর্তি। তিনি কৌরব সভায় অসম্মানিত হয়েছিলেন, কিন্তু তার সাহস ও বুদ্ধিমত্তা দেখিয়েছিল সম্পদ বা ক্ষমতা নয়, আত্মসম্মানই আসল। দ্রৌপদীর বিখ্যাত উক্তি:

“ক্ষমতাহীন নারীর জন্য সম্মানহীন জীবন মৃত্যুর মতো।”

তার এই কথায় আমরা বুঝতে পারি, সম্পদ বা ক্ষমতার চেয়ে জীবনের আসল শক্তি হলো নিজের আত্মসম্মান রক্ষা করা।

কর্ণ: ক্ষমতা পেলেও সুখ মেলেনি

কর্ণের গল্প একদমই ভিন্ন। তিনি ছিলেন সূর্যের পুত্র, কিন্তু সারাজীবন সমাজ তাকে সুতপুত্র বলেই অপমান করেছে। দুর্যোধনের পক্ষ নেওয়ার পর কর্ণ ক্ষমতা পেলেও তার ভিতরের দ্বন্দ্ব তাকে শান্তি দেয়নি। তার অন্তরের বেদনা ফুটে ওঠে এই উক্তিতে:

“আমি জানি আমার পথ ভুল, কিন্তু আমি বাধ্য।”

কর্ণের জীবন আমাদের শেখায়, ক্ষমতার লোভ যদি ন্যায় ও ধর্ম থেকে বিচ্যুত করে, তাহলে সেই ক্ষমতা জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে।

শ্রীকৃষ্ণ: সুখের প্রকৃত সংজ্ঞা

মহাভারতের আরেকটি বড় শিক্ষা আসে শ্রীকৃষ্ণের কাছ থেকে। তিনি বারবার বলেছেন, সুখ ভোগবিলাসের মধ্যে নেই, বরং নিজ কর্তব্য পালনে লুকিয়ে আছে। শ্রীকৃষ্ণ বলেছিলেন:

“কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন।”
(কেবল নিজের কর্মে মন দাও, ফলের আশা করো না।)

এই উক্তি থেকেই বোঝা যায়, সম্পদ বা ক্ষমতা নয়, কর্তব্যই প্রকৃত সুখ এনে দেয়।

মহাভারতের শিক্ষার আলোকে আমাদের জীবন

তুমি হয়তো ভেবেছ, “আমার জীবনে যদি আরও বেশি সম্পদ বা ক্ষমতা থাকত, তাহলে আমি সুখী হতাম।” কিন্তু মহাভারতের গল্পগুলো কি তোমাকে অন্য কিছু ভাবতে বাধ্য করছে না? সুখ পাওয়া যায় তখনই, যখন তুমি তোমার নৈতিকতা, কর্তব্য, এবং সম্পর্কের প্রতি সৎ থাকো।

উপসংহার:


মহাভারত আমাদের এক জ্বলন্ত প্রশ্নের মুখোমুখি করে: “সম্পদ ও ক্ষমতা পেয়ে তুমি সত্যিই সুখী হবে, নাকি আত্মতৃপ্তি ও ধর্মই প্রকৃত সুখের পথ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top