সুখের জন্য ধর্ম পালন কতটা গুরুত্বপূর্ণ, মহাভারত কী বলে?

আমাদের জীবনে সুখের গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই সুখ পাওয়ার মূল চাবিকাঠি কী? মহাভারতের পবিত্র শ্লোক ও কাহিনিগুলি আমাদের জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে ভাবতে শেখায়। মহাভারতের শিক্ষা অনুযায়ী, সুখের প্রকৃত উৎস হলো ধর্ম পালন। এই প্রবন্ধে আমি এবং আপনি একসঙ্গে ধর্মের গুরুত্ব এবং মহাভারতের অন্তর্নিহিত বার্তাগুলি বিশ্লেষণ করব।

ধর্ম: জীবনের নৈতিক ভিত্তি

“ধর্ম” শব্দটি শুনলে প্রথমেই মনে আসে সত্য, ন্যায় এবং কর্তব্য। মহাভারতে বলা হয়েছে:

“ধর্মো রক্ষতি রক্ষিতঃ।”
— যে ব্যক্তি ধর্মকে রক্ষা করে, ধর্মও তাকে রক্ষা করে।

এই শ্লোকটি আমাদের জানায় যে ধর্ম আমাদের জীবনের রক্ষাকবচ। মহাভারতের যুগে ধর্ম পালন কেবলমাত্র আধ্যাত্মিক দিকেই সীমাবদ্ধ ছিল না; এটি সামাজিক, পারিবারিক এবং ব্যক্তিগত দায়িত্ব পালনকেও অন্তর্ভুক্ত করত। যখন আমরা ধর্ম পালন করি, তখন আমাদের কর্ম, চিন্তা এবং অনুভূতিগুলি একটি সঠিক পথে পরিচালিত হয়।

যুধিষ্ঠিরের ধর্মনিষ্ঠা

মহাভারতে যুধিষ্ঠিরের জীবন থেকে আমরা ধর্মের প্রকৃত রূপ শিখি। দ্যুতক্রীড়ায় নিজের সবকিছু হারিয়েও তিনি ধর্মের পথ ছাড়েননি। যুধিষ্ঠির বলেছিলেন:

“ধর্ম এভ হি মম গতি।” — ধর্মই আমার একমাত্র পথ।

যুধিষ্ঠির সবসময় সত্যবাদী ছিলেন এবং প্রতিটি পরিস্থিতিতে ধর্মের মন্ত্র অনুসরণ করেছেন। তার এই ধর্মনিষ্ঠাই তাকে এক অনন্য ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছিল। যদি আপনি আপনার জীবনে সত্য ও ন্যায়ের পথে চলেন, তবে আপনি নিজেও সুখ এবং শান্তি অনুভব করবেন।

ধর্মের মাধ্যমে সুখ: বাস্তব উদাহরণ

  •  অর্জুনের শিক্ষা: কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের সময় অর্জুন যখন নিজের ভাইদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে দ্বিধান্বিত হয়েছিলেন, তখন শ্রীকৃষ্ণ তাকে ধর্ম এবং কর্তব্যের প্রকৃত অর্থ শেখান। তিনি বলেছিলেন:

“স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়ঃ, পরধর্মো ভয়াবহঃ।”
— নিজের ধর্মে মৃত্যুবরণ করা ভালো, অন্যের ধর্ম পালন ভয়ঙ্কর।

এই শ্লোকের মাধ্যমে কৃষ্ণ বুঝিয়েছিলেন যে নিজের কর্তব্য পালনই প্রকৃত সুখের পথ।

  •  ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা: ভীষ্ম পিতামহ তার পিতার ইচ্ছা পূরণের জন্য আজীবন ব্রহ্মচার্য ব্রত পালন করেছিলেন। তার এই ত্যাগ শুধু এক পরিবারের নয়, সমগ্র কৌরব বংশের ভিত্তি রক্ষা করেছিল। তিনি বলেছিলেন:

“প্রত্যেক ত্যাগই ধর্মের জন্য এবং ধর্মই সবকিছুর মূল।”

সুখ ও ধর্মের সম্পর্ক

আপনার কি মনে হয় যে সুখ কেবলমাত্র অর্থ, সম্পত্তি বা ক্ষমতার মধ্যে সীমাবদ্ধ? মহাভারত আমাদের শেখায় যে প্রকৃত সুখ হলো আভ্যন্তরীণ শান্তি। শ্রীকৃষ্ণ গীতায় বলেছেন:

“যঃ হি ন ব্যথ্যতে লোকাৎ, লোকান ন ব্যথ্যতে চ যঃ।”
— যে ব্যক্তি অন্যকে কষ্ট দেয় না এবং নিজেও কষ্ট পায় না, সে-ই সুখী।

এই শ্লোক আমাদের জানায় যে সুখ পাওয়ার জন্য আমাদের মন এবং আত্মার মধ্যে ভারসাম্য থাকা প্রয়োজন। আপনি যদি অন্যের জন্য ভালো কাজ করেন, তবে তা আপনার সুখের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়।

আপনার জীবনে ধর্মের প্রয়োগ

ধর্ম পালনের জন্য আপনাকে সন্ন্যাসী হতে হবে না। বরং আপনার দৈনন্দিন জীবনের ছোট ছোট কাজগুলিতে ধর্মের শিক্ষা প্রয়োগ করলেই যথেষ্ট। উদাহরণস্বরূপ:

  • সত্যবাদিতা পালন করুন: মিথ্যার মাধ্যমে সাময়িক লাভ হতে পারে, কিন্তু এটি দীর্ঘমেয়াদে শান্তি নষ্ট করে।
  • অন্যের প্রতি দয়া দেখান: দয়া এবং সহানুভূতিই প্রকৃত ধর্ম।
  • কর্তব্যে স্থির থাকুন: কর্মের মধ্যে নিয়মানুবর্তিতা এবং নিষ্ঠা আনুন।

মহাভারতের একটি প্রাসঙ্গিক গল্প

কর্ণের জীবন ধর্মের শিক্ষা দিয়ে ভরপুর। যদিও কর্ণের জন্ম একটি রাজপরিবারে হয়েছিল, কিন্তু তিনি সারা জীবন সামাজিক অবিচারের শিকার হয়েছিলেন। কর্ণ তার দাতা স্বভাব এবং প্রতিজ্ঞার জন্য বিখ্যাত। মৃত্যুর আগে কর্ণ তার সমস্ত সম্পত্তি দান করে দিয়েছিলেন। এ সম্পর্কে বলা হয়:

“দানের মাধ্যমে মানুষের আত্মা বিশুদ্ধ হয়।”

এই কাহিনি থেকে আমরা শিখি যে সুখ পাওয়ার জন্য ত্যাগ এবং দানের মূল্য অপরিসীম। আপনি যদি আপনার জীবনে দানের অভ্যাস গড়ে তোলেন, তবে তা আপনাকে অভ্যন্তরীণ সুখ দেবে।

সুখের সন্ধানে ধর্ম

মহাভারতের শ্লোক এবং কাহিনিগুলি আমাদের জানায় যে সুখের মূলে রয়েছে ধর্ম পালন। আপনার যদি মনে হয় যে জীবনে কোনো দিশা পাচ্ছেন না, তাহলে মহাভারতের শিক্ষা আপনাকে পথ দেখাতে পারে। সত্য, দয়া, কর্তব্য এবং ত্যাগ—এই চারটি মূল ভিত্তি যদি আপনি অনুসরণ করেন, তবে আপনার জীবন সুখ এবং শান্তিতে ভরে উঠবে।

তাহলে আপনি কি প্রস্তুত আপনার জীবনে ধর্মের পথে হাঁটতে? শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন:

“যে ব্যক্তি ধর্মের পথে চলে, সে-ই প্রকৃত সুখের অধিকারী।”

আপনার পথ কোনটি? আপনি কি ধর্মের মাধ্যমে সুখ খুঁজে পেতে চান? মহাভারতের শিক্ষা আমাদের জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে সাহস, দয়া এবং ন্যায়ের কথা মনে করিয়ে দেয়।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top