সুখ এবং দুঃখকে সমানভাবে গ্রহণ করার শিক্ষা মহাভারতে কোথায় পাওয়া যায়?

আপনি কি কখনও ভেবে দেখেছেন, জীবনে সুখ-দুঃখের খেলা আসলে আমাদের কী শেখায়? মহাভারতের মতো মহান গ্রন্থ আমাদের দেখায় কীভাবে এই দ্বন্দ্বকে মোকাবিলা করতে হয় এবং জীবনের গভীরতম শিক্ষাগুলি অর্জন করতে হয়। মহাভারত আমাদের জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে শেখার সুযোগ দেয়। সুখ এবং দুঃখকে সমানভাবে গ্রহণ করার যে শিক্ষা মহাভারতে আছে, তা আমাদের মানসিক শান্তি এবং জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্য বুঝতে সাহায্য করে।

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ এবং শ্রীকৃষ্ণের উপদেশ

গীতার দ্বিতীয় অধ্যায়ে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলেন:

“সমদুঃখসুখং ধীরং সঃ অমৃতত্ত্বায় কল্পতে।” — (ভগবদ গীতা ২.১৫)

অর্থাৎ, যিনি সুখ-দুঃখে সমান থাকেন এবং স্থির থাকেন, তিনিই মুক্তি লাভের যোগ্য। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধক্ষেত্রে, যখন অর্জুন নিজ পরিবার এবং প্রিয়জনদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন, তখন শ্রীকৃষ্ণ তাকে স্মরণ করিয়ে দেন জীবনের মায়া এবং মোহ থেকে মুক্ত থাকার গুরুত্ব। সুখ এবং দুঃখ উভয়ই জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ, এবং এগুলি আমাদের দায়িত্বপালনের পথে বাধা হতে পারে না।

যুধিষ্ঠিরের ধৈর্য

মহাভারতের আরেকটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হলো ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির। রাজ্য হারানোর পর যখন তিনি বনবাসে ছিলেন, তখনও তিনি নিজের ধৈর্য ও ন্যায়বোধ বজায় রেখেছিলেন। তিনি বলেছিলেন:

“ধৈর্যং সর্বোত্তমং ধনং।” — (মহাভারত)

অর্থাৎ, ধৈর্যই সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদ। যুধিষ্ঠির জানতেন, সুখ এবং দুঃখ কেবল ক্ষণস্থায়ী অভিজ্ঞতা। বনবাস এবং দুর্যোধনের অপমানজনক আচরণ সত্ত্বেও তিনি নিজের নৈতিকতা এবং দায়িত্ববোধ থেকে বিচ্যুত হননি। এটি আমাদের শেখায় কীভাবে প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও আমাদের স্থির থাকতে হয়।

দ্রৌপদীর অপমান এবং প্রতিশোধের ধৈর্য

দ্রৌপদী যখন কৌরব সভায় অপমানিত হন, তখন তিনি তৎক্ষণাৎ প্রতিশোধ নিতে পারেননি। কিন্তু তিনি তার দুঃখকে ধৈর্যের মাধ্যমে শক্তিতে রূপান্তরিত করেন। দ্রৌপদীর এই ধৈর্য এবং প্রতিশোধের প্রতীক্ষা আমাদের শেখায় যে, দুঃখের সময় মাথা ঠান্ডা রাখা এবং সময়ের সঠিক ব্যবহারে কীভাবে জীবনের বড় লক্ষ্য পূরণ করা যায়।

ভীষ্মের নির্লিপ্ত অবস্থান

ভীষ্ম পিতামহও সুখ এবং দুঃখকে সমানভাবে গ্রহণের উদাহরণ। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধক্ষেত্রে, তিনি তাঁর নিজের পরিবার এবং নীতিবোধের মধ্যে দ্বন্দ্বে ছিলেন। তিনি জানতেন যে যুদ্ধের পরিণতি কী হবে, কিন্তু তিনি তাঁর প্রতিজ্ঞার প্রতি অবিচল ছিলেন। মহাভারতের ভাষায়:

“যো ধর্মস্থত্ত্বং যুধিষ্ঠির।” — (মহাভারত)

অর্থাৎ, সত্য এবং ধর্মই সর্বশ্রেষ্ঠ। ভীষ্মের এই নির্লিপ্ত অবস্থান আমাদের শেখায় কীভাবে ব্যক্তিগত অনুভূতিকে পাশে রেখে ন্যায় ও ধর্ম মেনে চলতে হয়।

সুখ-দুঃখের পরিবর্তনশীল প্রকৃতি

মহাভারতের একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হলো, সুখ এবং দুঃখ উভয়ই সাময়িক। দ্রৌপদীর পঞ্চপাণ্ডবদের সঙ্গে রাজ্যভ্রষ্ট হওয়া এবং পুনরায় রাজ্য পুনরুদ্ধার করার ঘটনা এটি প্রমাণ করে। জীবনের প্রতিটি পরিবর্তন আমাদের একটি নতুন শিক্ষা দেয়।

শ্রীকৃষ্ণ গীতায় বলেন:

“মাত্রাস্পর্শাস্তু কাউন্তেয় শীতোষ্ণসুখদুঃখদাঃ। আগমাপায়িনো’নিত্যাঃ তাংস্তিতিক্ষস্ব ভারত।” — (ভগবদ গীতা ২.১৪)

অর্থাৎ, সুখ-দুঃখ আসা-যাওয়া করে। এগুলি সাময়িক এবং এগুলিকে সহ্য করতে শিখতে হবে।

আপনি কীভাবে এই শিক্ষাগুলি প্রয়োগ করবেন?

আপনি যখন জীবনে কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হন, তখন মহাভারতের এই শিক্ষাগুলি আপনাকে মানসিক শক্তি যোগাবে। নিজেকে জিজ্ঞাসা করুন:

  • আপনি কি সুখে এতটাই মগ্ন হয়ে যান যে, দুঃখ আসলে ভেঙে পড়েন?
  • আপনি কি দুঃখকে এতটাই গুরুত্ব দেন যে, সুখের মুহূর্তগুলিও অগ্রাহ্য করেন?

জীবনের প্রতিটি পরিস্থিতিতে ধৈর্য এবং স্থৈর্য বজায় রাখতে মহাভারতের শিক্ষা অনুসরণ করুন। মনে রাখবেন, জীবন একটি চক্রের মতো। সুখ-দুঃখের এই চক্র কখনও থামে না।

শেষ কথা

মহাভারতের শিক্ষা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, সুখ এবং দুঃখ জীবনের অংশ। এটি আসলে আমাদের অভিজ্ঞতা এবং জ্ঞানের পরিধি বাড়ায়। আপনি কি কখনও ভেবে দেখেছেন, মহাভারতের এই শিক্ষাগুলি আজকের জীবনে কতটা প্রাসঙ্গিক? আপনার জীবনের প্রতিটি পরিস্থিতিতে মহাভারতের নীতিগুলি কীভাবে প্রয়োগ করবেন? ভেবে দেখুন এবং নিজের জীবনের পথে এগিয়ে যান।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top